কোচের বিরুদ্ধে সাবিনাদের যত অভিযোগ

ইংলিশ কোচ পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে ভুরিভুরি অভিযোগ এনেছেন জাতীয় নারী ফুটবল দলের সদস্যরা। বৃহস্পতিবার বাফুফে ভবনের নিচে অনির্ধারিত প্রেস ব্রিফিংয়ে সাবিনা-মাসুরা পারভীনরা তাদের অভিযোগগুলো তুলে ধরেন।

এ সময়ে সানজিদা, কৃষ্ণা, মনিকা, মারিয়া, নীলা, তহুরা, শিউলি আজিম, ঋতুপর্ণা চাকমাসহ আরো ১৫ ফুটবলার উপস্থিত ছিলেন। যাদের বেশিরভাগই দুইবার সাফজয়ী দলের সদস্য।

লিখিতভাবে সাবিনারা কোচ পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছেন তা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো-

১. একটা ক্রান্তিকালে আপনাদের সামনে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছি। আপনাদের মাধ্যমে সারাদেশের মানুষ জেনেছে কতটা প্রতিকূল পথ পাড়ি দিয়ে আমরা টানা দুইবার দেশের মানুষের জন্য সাফ শিরোপা এনে দিয়েছি। এই পর্যায়ে আসতে আমাদের কতটা পরিশ্রম করতে হয়েছে, কত বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে, এ সবকিছুই আপনাদের জানা।

গত বছর অক্টোবরে নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে আরেকবার প্রমাণ দিয়েছি, আমরাই সেরা। সেই টুর্নামেন্ট চলাবস্থায় দলের কোচ পিটার বাটলারের সঙ্গে দলের খেলোয়াড়দের দূরত্ব প্রকাশ্যে এসেছিল। ইচ্ছেমতো একাদশ গড়ে তিনি দলকে ডোবাতে চেয়েছিলেন।

২. পাকিস্তানের বিপক্ষে সিনিয়র ফুটবলারদের বাদ দিয়ে কোচ যে একাদশ করেছিলেন তা যে ভুল ছিল, সেটা সবাই দেখেছেন। কারণ; ওই ম্যাচ আমরা হারতে হারতে কোনরকমে ড্র করেছিলাম। ভারতের বিপক্ষে আমাদের চাপে তিনি একাদশ বদলাতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং সিনিয়র খেলোয়াড় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দল ভারতকে হারিয়ে গ্রুপ সেরা হয়েছিল।

এটাই প্রমাণ করে আমরাই সঠিক ছিলাম। কিন্তু; ওই ম্যাচে নামার আগেই জানতাম কোচের বিরুদ্ধে একরকম বিদ্রোহে এই একাদশ তৈরি হয়েছিল। আমরা ব্যর্থ হলে দেশের মানুষের কাছে ভিলেন হয়ে যেতাম। ওই ম্যাচেই আমাদের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতো। এটা বুঝেও আমরা ঝুঁকি নিয়েছিলাম, দেশের হয়ে লড়াই করার জন্য। দেশের জন্য আমাদের এই লড়াই ও আবেগ, ভালোবাসার মূল্য ফুটবল ফেডারেশন থেকে আশা করেছিলাম।

৩. সাফ থেকে ফেরার পর যা হয়েছে তার জন্য আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। এই বিতর্কিত ব্যক্তির সঙ্গে আরও দুই বছরের চুক্তি নবায়ন করেছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। এই সিদ্ধান্তে মেয়েদের দাবি-দাওয়াকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে করা হয়েছে।

৪. খেলোয়াড়দের সঙ্গে নেপালে ঘটে যাওয়া এতো এতো ঘটনার পরও কোচ পারতেন বিষয়টি সেখানেই সমাধান করতে। সাফ জিতে আসার পরপরই তিনি পারতেন আমাদের সঙ্গে বসতে। সেটা না করে বরং আমাদের ইগনোর করেছেন প্রতিনিয়ত। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম যে উনি কখন মিটিং ডাকবেন। কিন্তু ডাকেননি।

বাংলাদেশে এসে বাফুফের এক ভাইস প্রেসিডেন্ট আমাদের ইস্যু নিয়ে কোচের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং ওনাকে ওনার ব্যবহার আচার সম্পর্কে সতর্ক হতে বলেন। আমাদের প্রশ্ন হলো ওনাকে কেন সতর্ক করতে হবে, ওনার নিজের কি কোনো জ্ঞান-বুদ্ধি নেই যে ওনার কি করা উচিৎ, কি করা উচিৎ নয়?

৫. বাংলাদেশের মহিলা ফুটবলে এই ঘটনা একেবারেই প্রথম। একটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে কোচ ভুলে যান যে তার হাতে ৫টা পরিবর্তন আছে! সাফের প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে আমরা যখন ১-০ গোলে হারার পথে, তখন হেড কোচ সানজিদাকে নামানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু নামানোর সময় দেখেন খেলোয়াড় বদলের কাগজ তার কাছে নেই।

আগে তিনটা পরিবর্তন করায় সঙ্গে থাকা তিনটি কাগজই শেষ হয়ে গেছে! তখন ম্যাচের ৯৫ মিনিট চলে। যেখানে বাংলাদেশ ১-০ গোলে পিছিয়ে রয়েছে। তখনও বাংলাদেশের হাতে ২টা খেলোয়াড় পরিবর্তনের অপশন ছিলো ;কিন্তু কাগজ ছিলো না। ব্যপারটা খুবই লজ্জাজনক ও হাস্যকর। এতো বড় ডিগ্রিধারী কোচের থেকে এটা আশা করা যায় না।

৩. ওই ম্যাচেই কৃষ্ণাকে নামানোর আগ মূহুর্তে এক সহকারী কোচ তার জার্সির নাম্বার জিজ্ঞেস করলে আরেকজন টিমমেট বলে দেয়। কৃষ্ণা তখনও সেভ গার্ড পরায় ব্যাস্ত থাকায় দ্বিতীয়বার আবার জিজ্ঞেস করেন জার্সি নাম্বার। আবারও অন্য টিমমেট বলে দেওয়ায় কোচ রেগে কৃষ্ণার দিকে তেড়ে আসেন। মামুলি জার্সি নাম্বার না বলায় এ রকম আচরণ কোনো কোচের পক্ষে সম্ভব কিনা আমাদের জানা নেই।

৬. কেবল মাঠ নয়, মাঠের বাইরেও প্রতিনিয়ত কোচ আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। আমাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করেন। দলের অভ্যন্তরে খেলোয়াড়দের মধ্যে সিনিয়র-জুনিয়রের কথা বলে বিভাজনের সৃষ্টি করেছেন। মেয়েদের পোশাক-আশাক নিয়ে কথা বলতে ছাড়েননি। বডি শেমিংও করেছেন। মেয়েদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলেন, বাজে মন্তব্যও করেন কোচ।

৭. আমাদের বিরুদ্ধে কোচ সবসময় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ করেন। এটা যে ডাহা মিথ্যা কথা, তার বড় প্রমাণ হলো- অতীতের কোন কোচ মেয়েদের শৃঙ্খলা নিয়ে কখনো কোন প্রশ্ন তুলতে পারেননি। পিটারের এ রকম উল্টা-পাল্টা আরচণের বিষয়গুলো সহকারী কোচরাও জানেন। কিন্তু তারা চাকুরি যাওয়ার ভয়ে মুখখোলেন না।

৮. আমাদের সঙ্গে কোচ যা যা ঘটিয়েছেন, তা জানিয়ে আমরা বাফুফের মাননীয় সভাপতির কাছে গত বুধবার একটি চিঠি দিয়েছি। যে চিঠিতে আমরা লিখেছি- আমরা একটি জটিল বিষয় আপনার নজরে আনতে লিখছি। কোচ পিটারের আচরণ দলের মধ্যে মারাত্মক উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে, যা একটি বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে ক্যাম্পে। এটা আমাদের খেলোয়াড়দের মানসিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ করছে।

৯. গত ছয় মাসে পিটারের কাছ থেকে আমাদের অনেক গালিগালাজ শুনতে হয়েছে। আমাদের মানসিক হয়রানি এবং উৎপীড়নের একাধিক ঘটনা ঘটিয়েছেন কোচ। তার কারণে ক্যাম্পে একটি আতঙ্ক বিরাজ করছে। খেলোয়াড়রাও তাতে ভীষণ অসম্মানিত এবং হতাশার মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন। খেলোয়াড়রা, বিশেষ করে দলের সিনিয়র সদস্যরা, ধারাবাহিক বৈষম্য এবং অন্যায় আচরণের শিকার হচ্ছেন।

কোচের এসব আচরণ কেবল অবমাননাকর নয়, দলগতভাবে পারফরর্ম করার ক্ষেত্রেও বাধা সৃষ্টি করেছে। এটা মানতে হবে যে, কোচিংয়ে শুধুমাত্র কৌশল এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকলেই হয় না, বরং পারস্পরিক সম্মান, বিশ্বাস এবং সমর্থনের পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষমতাও কোচের থাকতে হয়। দুর্ভাগ্যবশত, কোচ পিটারের নেতৃত্বে, খেলোয়াড়রা বিচ্ছিন্ন এবং হতাশাগ্রস্ত বোধ করে, যা একটি বাজে সংস্কৃতি তৈরি করেছে।

১০. আমরা কোন অবস্থাতেই দলে বিভাজন চাই না। তাই বিভাজন সৃষ্টি করা কোচকেও আমাদের প্রয়োজন নেই। কোচ পিটার কিছু জুনিয়র ফুটবলারকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করে দলের অভ্যন্তরে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছেন। কিছু মেয়েদের ব্যবহার করে মিথ্যাচারও করছেন।

তিনি সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, আমরা সিনিয়ররা নাকি জুনিয়র মেয়েদের চাপ দিচ্ছি যাতে তার অধীনে অনুশীলনে অংশ না নেয়। আমরা পরিস্কার জানাতে চাই, আমাদের পক্ষ থেকে কাউকে কোন প্রকার চাপ প্রয়োগ করা হয়নি। ভালো-মন্দের বিচার করার বয়স-জ্ঞান ক্যাম্পে থাকা প্রতিটি মেয়ের হয়েছে। সুতরাং সবাই নিজ নিজ সিদ্ধান্তেই তাদের অবস্থান বেছে নিয়েছে।

১১. পরিশেষে বলতে চাই, আমরা আশা করছি বাফুফের মাননীয় সভাপতি বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিয়ে আশু সমাধানের ব্যবস্থা নেবেন। এর আগ পর্যন্ত আমরা পিটারের অধীনে কোন ট্রেনিং ক্যাম্পে অংশ নেবো না। যেহেতু গত অক্টোবরের পর কোন ফুটবলারের সঙ্গে বাফুফে কোন চুক্তি নবায়ন করেনি, তাই আইনত বাফুফে আমাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার রাখে না।

তারপরও যদি সেরকম কিছু করার সিদ্ধান্ত হয় এবং পিটার বাটলারকেই রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্তে বাফুফে অনড় থাকে, তবে আমরা এক যোগে পদত্যাগ করতে বাধ্য হব। ভেবে নিব, দেশের নারী ফুটবলে আমাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।

  • Related Posts

    তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত অনশন চলবে,ব্যর্থ হয়ে ফিরলেন যুগ্মসচিব

    সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) দুপুর ১২টা থেকে তাদের অবরোধ শুরু হয়। রাত ১০টায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চলছে।…

    Continue reading
    শিক্ষার্থীরা দল গঠন করবে: ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে প্রধান উপদেষ্টা

    শিক্ষার্থীরা দল গঠন করতে পারে ও এ লক্ষ্যে তারা জনগণকে সংগঠিত করছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের একটি পডকাস্টে এমন…

    Continue reading

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত অনশন চলবে,ব্যর্থ হয়ে ফিরলেন যুগ্মসচিব

    তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত অনশন চলবে,ব্যর্থ হয়ে ফিরলেন যুগ্মসচিব

    শিক্ষার্থীরা দল গঠন করবে: ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে প্রধান উপদেষ্টা

    শিক্ষার্থীরা দল গঠন করবে: ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে প্রধান উপদেষ্টা

    যুক্তরাষ্ট্রে উড়োজাহাজ-হেলিকপ্টার সংঘর্ষে সব আরোহীর মৃত্যুর শঙ্কা

    যুক্তরাষ্ট্রে উড়োজাহাজ-হেলিকপ্টার সংঘর্ষে সব আরোহীর মৃত্যুর শঙ্কা

    মুন্সিগঞ্জে দুগ্রুপের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ২

    মুন্সিগঞ্জে দুগ্রুপের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ২

    জামালপুরে ট্রাকচাপায় অটোরিকশার ৫ আরোহী নিহত

    জামালপুরে ট্রাকচাপায় অটোরিকশার ৫ আরোহী নিহত

    কোচের বিরুদ্ধে সাবিনাদের যত অভিযোগ

    কোচের বিরুদ্ধে সাবিনাদের যত অভিযোগ

    ভালোবাসা দিবসে অপূর্ব-নিহার ‘মন-দুয়ারী’

    ভালোবাসা দিবসে অপূর্ব-নিহার ‘মন-দুয়ারী’

    বেতন না পেয়ে ভাঙচুর মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকের ২ বছরের কারাদণ্ড

    বেতন না পেয়ে ভাঙচুর মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকের ২ বছরের কারাদণ্ড

    চাঁদ দেখা যায়নি, ১৪ ফেব্রুয়ারি শবে বরাত

    চাঁদ দেখা যায়নি, ১৪ ফেব্রুয়ারি শবে বরাত

    যুক্তরাষ্ট্রে বিমান ও হেলিকপ্টার সংঘর্ষের ঘটনায় ৩০ মরদেহ উদ্ধার: সিবিএস নিউজ

    যুক্তরাষ্ট্রে বিমান ও হেলিকপ্টার সংঘর্ষের ঘটনায় ৩০ মরদেহ উদ্ধার: সিবিএস নিউজ