ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয়!

বুঝে বা না বুঝে চিল্লাচিল্লি করা সবার মত আমাদের বাংগালী মোল্লা সমাজের একটি মুদ্রা দোষ।
মূর্তি, যাকে ইংরেজীতে আমরা Idol ( আইডল ) বলি, তৈরি করা হয় নিছক উপাসনার জন্য। ইসলামে ইহা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারন আমরা মুসলমানরা ইবাদত করি শুধু এবং শুধু এক লা শরীক আল্লাহর জন্য। যেজন্য মহান আল্লাহ সূরা ফাতিহায় শুধু ‘না’বুদু’ না শিখিয়ে আমাদেরকে শিখিয়েছেন ‘ইয়্যাকা না’বুদু’। যার অর্থ ‘একমাত্র ও ই’ যুক্ত করেই বুঝতে হবে যে, একমাত্র আপনারই ইবাদত বা উপাসনা আমরা করি।
এজন্য ‘শিরিক শিরিক’ স্লোগন করে এক শ্রেণীর মোল্লাদের সব জায়গায় বলে বেডানো নিছক আল্লাহর বাণীকে না বুঝারই নামান্তর বলে মনে করি। যদি আল্লাহ ‘ইয়্যাকা’ না বলে শুধু ‘না’বুদু’ বলতেন, তাহলে মা-বাবা ও বুজুর্গদের সম্মান দেখিয়ে কদমবুচি, পায়ে ধরে সালাম করা ও ভাস্কর্য বানানো বা স্থাপন করা সবই ইসলামে নিষিদ্ধ হয়ে যেতো। অর্থাৎ মুসলমানের উপাসনা বা ইবাদত করলে একমাত্র তা আল্লাহর জন্যই করা আবশ্যক। পক্ষান্তরে ভাস্কর্য, যাকে ইংরেজীতে Sculpture ( স্কাল্পচার ) বলা হয়, তা তৈরি করা হয় ইতিহাসের বিখ্যাত মানুষদের অবদানকে তাঁদের বিশেষ কোনো কর্মের কারনে স্মরণে রাখার জন্য। মোটেও তাঁদেরকে আল্লাহর মত ইবাদত বা উপাসনা করার জন্য নয়। একে আমরা Cultural Development ( যুগ জামানার পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক উন্নয়ন ) ও বলতে পারি।। আমি অমুসলিম দেশের ভাস্কর্য্যের কথা বলবোনা, নতুবা আমাদের মোল্লা সমাজ ‘কাফেরদের কথা বাদ দেন’ বলে তা উডিয়ে দেবেন। কারন কোনো মৃতকে জীবিত করে বুঝানো সম্ভব হলেও মওদুদী মার্কা ভুয়া ইসলামে মস্তিষ্ক ধোলাইকৃত আমাদের মোল্লা সমাজ, যারা ইসলাম চর্চার বিনিময়ে ইসলামকে ও ইসলামী আচরণকে নিয়ে করেন ব্যবসা, যাকে অন্য শব্দে আমরা ‘ধর্মজীবী’ বলেও আখ্যায়িত করতে পারি। আর নয়তো ধর্মকে নিয়ে তারা করেন রাজনীতি। তবে এমন ব্যবসা শুধু মুসলমান ধর্মেই বা আমাদের বাংলাদেশেই নয়, বরং আমাদের পার্শ্ববর্তী ও প্রতিবেশী দেশ ভারতেও আছে। যারা তাদের ভারতকে ইসরাঈলের ইহুদী রাষ্ট্রের অদলে একটি হিন্দু রাষ্ট্র বানাবার লক্ষ্যে মাঝে মাঝে সেখানের সংখ্যালঘুদের সাথে নির্মম ও অগণতান্ত্রিক আচরণ চর্চার মাধ্যমে করে থাকেন বলে আমরা দেখতে পাই।
সম্প্রতি কিছু বিপথগামী চরমপন্থীদের বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংগা ও আবূ সাঈদের ভাস্কর্য নির্মাণকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যে ধর্মীয় উন্মাদনা ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে সে আলোকেই সচেতনতা সৃষ্টির জন্য দায়িত্ববোধ থেকেই আমার এই লিখাটি।
আবূ সাঈদ পরিবারের জন্য সরকারী মন্জুরির পরেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে মলিন করে পরিস্থিতির সুযোগ নিতে ও নিষিদ্ধের হুলিয়াকে মাথা থেকে সরাতে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করত কেউ কেউ আবু সাঈদ পরিবারকে ৬ লক্ষ টাকা দিয়ে ও তার কবরের পাশে দাঁডিয়ে লম্বা মোনাজাত ধরার পর তা মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার শেষে সতীর্থদের দিয়ে ( বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংগার অপরাধকে ঢাকতে ) আবূ সাঈদ পকিবারকে ভাস্কর্য নির্মাণ বিরোধী মগজ ধোলাই করার কৌশল দেখে অনেকের মত আমিও হাসবো, নাকি কাঁদবো, ভেবে পাচ্ছিনা।
আসুন, এবার দেখি মুসলিম দেশ সমূহের ভাস্কর্য নির্মাণ কেমন ছিল? বিখ্যাত মানুষদের অবদানকে চির স্মরণীয় করে রাখতে ভাস্কর্য নির্মাণ কালে সেসব দেশের ইমাম-আলেম-উলামারা ( যারা বাংলাদেশের আজকালকার লাফাইন্যা মোল্লাদের চেয়ে ছিলেন বহুগুণে শিক্ষিত, মার্জিত ও সম্মানিত। ) ভাস্কর্য নির্মাণের সময় তাতে কোনো আপত্তি না করেই বোর্ড বসিয়ে তাদের সরকারকে এর অনুমতি প্রদান করেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশে ভাস্কর্য ভাংগা ও ভাস্কর্য গডা নিয়ে যে আজব কান্ড এক শ্রেণীর স্বল্প কিংবা অর্ধ শিক্ষিত মোল্লা সমাজে আমরা লক্ষ্য করছি, তা নিতান্তই পীডা ও বেদনা দায়ক। দেখে মনে হচ্ছে, এসবের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। আবার কোনো কোনো সময় এও চিন্তা করি যে, এসব হিংসাত্মক কার্যকলাপ, শুধুই কি হিংসা, নাকি ধর্মীয় উন্মাদনাও এতে বিদ্যমান ছিল।
যাক, আসুন আমরা পাকিস্তানের দিকে তাকাই। তারা তাদের পাকবন্ধু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে স্মরণীয় করে রাখতে কিভাবে তাঁর ভাস্কর্যকে তারা স্থাপন করেছেন।
পাকিস্তানের লাহোরের আলহামরা ইউনিভার্সিটিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একটি বিশাল ভাস্কর্য আছে। ভাস্কর্যটি ফাইবার দিয়ে বানানো। দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন এমন মানুষের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে দেশটিতে। সে তালিকাতেই স্থান পেলেন জিন্নাহ। ২০১৮ সালে এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৯৯৮ সালে ন্যাশনাল কলেজ অব আর্টস থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা রিজওয়ান হায়দার এই ভাস্কর্যটির নকশা করেছেন। এটি নির্মাণে খরচ হয়েছে পাঁচ লাখ রুপি। জিন্নাহর আরও একটি ভাস্কর্য আছে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের আলহামরা কালচারাল কমপ্লেক্সে। এটিও রিজওয়ানের নকশা করা। শীত-গ্রীষ্মসহ সব আবহাওয়া সামলে এই ভাস্কর্য অন্তত ৫০ বছর এমনই থাকবে।
এবার আসুন মালেশিয়ায় যাই। লন্ডনে বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের শেল্টার দেয়ার মত যারা মুসলিম ধর্মীয় চরমপন্থীদের শেল্টার প্রদান করে থাকে। দেখি, তারা কি করেছেন?
তারা তাদের ন্যাশনাল মনুমেন্ট, মালেয়শিয়াকে উন্নত করতে আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে মালয়েশিয়ার সাফল্যকে এককথায় চোখ ধাঁধানো করে রেখেছেন। মুসলিম বিশ্বে ১৩তম অবস্থানের এই দেশটিতে জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি ৮০ লাখ। দেশটির ৬০.৪ শতাংশ মানুষই মুসলিম। মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত ভাস্কর্য ওয়াশিংটন মনুমেন্টের আদলে গড়া ন্যাশনাল মনুমেন্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৪৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত চলা জরুরি অবস্থায় শহীদ হয়েছেন বেশ কয়েকজন মালয়েশিয়ান সেনা। তাদের সম্মানে সাতজন প্রতীকী বীরের প্রতিমূর্তি নির্মাণ করা হয়েছে দেশটির রাজধানী কুয়ালালামপুরে। ১৯৬৬ সালে ভাস্কর্যটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। মালয়েশিয়ার হাউজ অব পার্লামেন্টের কাছে এটি অবস্থিত। ব্রোঞ্জ দিয়ে নির্মিত ভাস্কর্যটি ১৫ মিটার লম্বা। প্রতি বছর ৩১ জুলাই দেশটির প্রধানমন্ত্রী, মালয়েশিয়ান সেনাবাহিনীর প্রধান এবং রয়্যাল মালয়েশিয়া পুলিশের পক্ষ থেকে ন্যাশনাল মনুমেন্টে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
কই, কোনো মুসলিম চরমপন্থী এর কোনো প্রতিবাদ তো করেননি।
সুলতান সালাদিন, সিরিয়াঃ
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়ার জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। দেশটির প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলিম। সুন্নি প্রধান এ দেশেও রয়েছে শিয়া-সুন্নি-কুর্দি দ্বন্দ্ব
সিরিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত ভাস্কর্যটি হলো বীর মুসলিম সেনাপতি সালাদিন স্মরণে নির্মিত ‘স্ট্যাচু অব সালাদিন’। ব্রোঞ্জের তৈরি এই ভাস্কর্যটি সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের কেন্দ্রস্থল সিটাডেল অব দামেস্কে অবস্থিত। ৪ মার্চ, ১৯৯৩ সালে সিরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাফিজ আসাদ কুর্দি বংশোদ্ভূত সুলতান সালাদিনের ৮০০ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন। ঐতিহাসিক ভাস্কর্যটির ভাস্কর আবদুল্লাহ-আল-সাঈদ।
এই ফিরিস্তি আরোও অনেক লম্বা। বুঝার জন্য এ তিনটে উদাহরণই যথেষ্ট মনে করি।

  • MILLENNIUMTVAMERICA

    Related Posts

    শাহজালাল বিমানবন্দরে ওয়েটিং লাউঞ্জ উদ্বোধন করলেন প্রধান উপদেষ্টা

    বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) বিমানবন্দরের মাল্টিলেভেল কার পার্কিং এলাকার দ্বিতীয় তলায় যাত্রীদের জন্য প্রশস্ত ও আরামদায়ক ওয়েটিং লাউঞ্জ উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই লাউঞ্জে ওয়েটিং এরিয়া,…

    Continue reading
    মাদাগাস্কারে নৌকায় ভূমিধসে ১৬ জনের মৃত্যু

    মাদাগাস্কারের পশ্চিমাঞ্চলের তসিরিবিহিনা নদীতে ভূমিধসের কারণে একটি নৌকায় থাকা অন্তত ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।  মাদাগাস্কারের মেরিটাইম, পোর্ট এবং রিভার এজেন্সির মতে, মঙ্গলবার রাতে এই দুর্ঘটনা ঘটে। সংস্থাটির দেওয়া বিবৃতি অনুযায়ী,…

    Continue reading

    ময়মনসিংহে বাস উল্টে পুকুরে, নিহত ১ আহত ৮

    ময়মনসিংহে বাস উল্টে পুকুরে, নিহত ১ আহত ৮

    শাহজালাল বিমানবন্দরে ওয়েটিং লাউঞ্জ উদ্বোধন করলেন প্রধান উপদেষ্টা

    শাহজালাল বিমানবন্দরে ওয়েটিং লাউঞ্জ উদ্বোধন করলেন প্রধান উপদেষ্টা

    মাদাগাস্কারে নৌকায় ভূমিধসে ১৬ জনের মৃত্যু

    মাদাগাস্কারে নৌকায় ভূমিধসে ১৬ জনের মৃত্যু

    কালিহাতীতে আগুনে ১৮ দোকান পুড়ে ছাই

    কালিহাতীতে আগুনে ১৮ দোকান পুড়ে ছাই

    ভিনির পেনাল্টি মিসে হতাশার ড্র ব্রাজিলের

    ভিনির পেনাল্টি মিসে হতাশার ড্র ব্রাজিলের

    রবীন্দ্রনাথকে অবমাননা, আইনি নোটিশ সালমান খানকে

    রবীন্দ্রনাথকে অবমাননা, আইনি নোটিশ সালমান খানকে

    মালয়েশিয়ায় সুদের কারবার করা সেই ৬ বাংলাদেশিকে অর্থদণ্ড

    মালয়েশিয়ায় সুদের কারবার করা সেই ৬ বাংলাদেশিকে অর্থদণ্ড

    দেশে ফিরলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস

    দেশে ফিরলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস

    ইসরাইলের সামরিক সদর দপ্তরে হিজবুল্লাহর ড্রোন হামলা

    ইসরাইলের সামরিক সদর দপ্তরে হিজবুল্লাহর ড্রোন হামলা

    ডেঙ্গুতে আরও পাঁচজনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১১০৭

    ডেঙ্গুতে আরও পাঁচজনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১১০৭