২৯ আগস্ট ১৯৯৪। নিজেদের প্রথম অ্যালবাম মুক্তির পরই শোরগোল ফেলে দেয় আনকোরা নতুন ব্রিটিশ এক রক ব্যান্ড, পরের এক দশকে তারা হয়ে ওঠে বিশ্বসংগীতে অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী ব্যান্ড। এরপর ধীরে ধীরে খেই হারাতে থাকে তারা, গত এক দশকের বেশি সময় তো দৃশ্যপটেই ছিল না। প্রথম অ্যালবাম মুক্তির ৩০ বছর পূর্তির ঠিক দুই দিন আগে পুনর্মিলনীর ঘোষণা দিল তারা; জানাল, আগামী বছর কনসার্ট করবে। এর পর থেকেই কনসার্টের টিকিট নিয়ে রীতিমতো হুলুস্থুল। বিশ্বসংগীতের ভক্তরা নিশ্চয় এরই মধ্যে বুঝে গেছেন, কার কথা হচ্ছে। গত ২৭ আগস্ট ‘ওয়েসিস লাইভ ’২৫ ট্যুর’-এর ঘোষণা দিয়েছে ওয়েসিস।
একনজরে ওয়েসিস
প্রতিষ্ঠা: ১৯৯১
প্রথম অ্যালবাম: ডেফিনেটলি মেবি (১৯৯৪)
গানের ধরন: রক ব্যান্ড
বিক্রি: বিশ্বব্যাপী ৭৫ মিলিয়নের বেশি রেকর্ড বিক্রি
পুনর্গঠন: ২৭ আগস্ট ২০২৪
কনসার্ট: ‘ওয়েসিস লাইভ’২৫ ট্যুর’, ৪ জুলাই থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বর্তমান সদস্য: নোয়েল ও লিয়াম গ্যালাগার
রেকর্ড আর রেকর্ড
বেজিস্ট পল ম্যাকগুইগান, গিটারিস্ট পল আর্থারস, ড্রামার টনি ম্যাকক্যারল ও ভোকাল ক্রিস হাটনের হাত ধরে ১৯৯১ সালে তৈরি হয় ব্যান্ড দ্য রেইন। কিন্তু হাটনের সঙ্গে বাকি সদস্যদের ঠিক জমছিল না। নতুন ভোকালের খোঁজে শুরু হয় অডিশন। এভাবেই ব্যান্ডে যুক্ত হন লিয়াম গ্যালাগার, ব্যান্ডের নতুন নাম দেন তিনি ওয়েসিস। পরে লিয়ামের ভাই নোয়েল গ্যালাগারও ব্যান্ডে যুক্ত হন।
১৯৯৪ সালের ২৯ আগস্ট বাজারে আসে ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবাম ‘ডেফিনেটলি মে বি’। ‘সুপারসনিক’, ‘শেকারমেকার’, ‘লিভ ফরএভার’ গানসহ পুরো অ্যালবাম যুক্তরাজ্যে ঝড় তোলে, সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া প্রথম অ্যালবামের রেকর্ড গড়ে। যুক্তরাষ্ট্রেও ব্যাপক সাফল্য পায় অ্যালবামটি, পায় প্লাটিনাম সনদ। কেবল কি এই অ্যালবাম, ১৯৯৫ ও ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত অন্য দুই অ্যালবাম ‘(হোয়াটস দ্য স্টোরি) মর্নিং গ্লোরি?’ ও ‘বি হেয়ার নাউ’ও ব্যাপক সাফল্য পায়।
মূলত ‘মর্নিং গ্লোরি?’ অ্যালবামটি দিয়ে সারা দুনিয়ার শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে যায় ওয়েসিস, যুক্তরাজ্যে মুক্তির প্রথম সপ্তাহে অ্যালবামটির রেকর্ড ৩ লাখ ৪৫ হাজার কপি বিক্রি হয়। ‘বি হেয়ার নাউ’ অ্যালবামটিও রেকর্ড ভাঙার দিক থেকে পিছিয়ে ছিল না। এটি তখন সবচেয়ে দ্রুত বিক্রি হওয়া অ্যালবামের রেকর্ড গড়ে, ১৫টি দেশের টপ চার্টের শীর্ষ ওঠে।
পথ যখন আলাদা
২০০৫ সালে ষষ্ঠ স্টুডিও অ্যালবাম ‘ডোন্ট বিলিভ দ্য ট্রুথ’ও সাফল্য পায়। ২০০৯ সালে অ্যানুয়াল মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস শোতে সেরা ব্রিটিশ ব্যান্ডের স্বীকৃতি পায় ওয়েসিস। মোটাদাগে এ পর্যন্ত ওয়েসিস কক্ষপথেই ছিল, এর পর থেকে ব্যান্ডটির জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। সদস্যদের মধ্যেও নানা বিষয়ে দেখা যায় দ্বন্দ্ব। ২০০৯ সালের ২৮ আগস্ট প্যারিসের একটি উৎসবে ওয়েসিসের গাওয়ার কথা ছিল; কিন্তু শেষ মুহূর্তে নাম প্রত্যাহার করে নেয় তারা। তখন ব্যান্ড থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন নোয়েল, কয়েক বছর পর চলে যান লিয়ামও। মূলত দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্বের জেরেই ভেঙে যায় ব্যান্ড, দুই ভাই গড়েন একক ক্যারিয়ার; যেখানে দুজনই সাফল্য পান।
ষাট–সত্তরের স্মৃতি
‘তাদের গানে বিটলসের ছোঁয়া পাই’—ওয়েসিসের গান কেন পছন্দ, জানতে চাইলে বেশির ভাগ শ্রোতাই এমন উত্তর দেন। এ জন্য তাঁদের দোষও দেওয়া যায় না, আলোচিত এই ব্রিটিশ ব্যান্ডের গায়কি, সুরে বিটলসের প্রভাব স্পস্ট। এটা তাদের সমালোচনা নয়; বরং বিটলস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ওয়েসিস যেভাবে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছে, সেটার জন্য তারা প্রশংসাই পেয়েছে। কেবল কি বিটলস, ওয়েসিসের গানে খুঁজে পাওয়া যায় গত শতকের ষাট ও সত্তরের দশকের জনপ্রিয় বিভিন্ন ব্যান্ডের প্রেরণা।
মূলত রক গাইত ওয়েসিস, তবে তাদের গানের ঘরানাকে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয় ব্রিটপপ। নব্বইয়ের ব্রিটিশ পপ কালচারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাম ওয়েসিস, নিজেরাও অনেক ব্যান্ড আর শিল্পীকে অনুপ্রাণিত করেছে। যে তালিকায় অবধারিতভাবেই আসবে আর্কটিক মাঙ্কিস, ক্যাটফিশ অ্যান্ড দ্য বটলমেন, কোল্ডপ্লে, রায়ান অ্যাডামসের নাম।
গান চুরির অভিযোগে ওয়েসিসের সমালোচনাও কম হয়নি। নোয়েল গ্যালাগারের বিরুদ্ধে তিনবার মামলা হয়। তবে ২০১০ সালে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নোয়েল জানিয়েছেন, অন্য গানের লাইন বা মূল ভাবের সঙ্গে তাঁর গান মিলে যাওয়া নেহাতই কাকতাল।
ঘোষণাতেই ঝড়
আগামী বছর ওয়েলস, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে ‘ওয়েসিস লাইভ’২৫ ট্যুর’-এ ১৪ কনসার্টের ঘোষণা দিয়েছে ওয়েসিস। ২০২৫ সালের ৪ জুলাই কার্ডিফে শুরু হওয়া কনসার্ট শেষ হবে ২৮ সেপ্টেম্বর, লন্ডনে। চলতি বছর টেলর সুইফটের শো যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে যে অবদান রেখেছে, দ্য ইকোনমিক টাইমস বলছে, আগামী বছর ওয়েসিসের ১৪ কনসার্টও তেমন ভূমিকা রাখবে। কনসার্ট উপলক্ষে অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরুর পর থেকেই হুমড়ি খেয়ে পড়েন যুক্তরাজ্যের শ্রোতারা। সেটা এতটাই যে ১২৮ পাউন্ডের টিকিটের দাম উঠে যায় ৩৫০ পাউন্ড পর্যন্ত! বহুল আলোচিত এই পুনর্মিলনী কনসার্টের টিকিট বিক্রি হচ্ছে ডায়নামিক পদ্ধতি মেনে, যেখানে চাহিদার সঙ্গে টিকিটের দাম বেড়ে যায়। তবে এতেও অখুশি নন ভক্তরা। এত দিন পর ওয়েসিস আবার পুরোনো রূপে ফিরতে পারবে কি না, সে আলোচনাও আছে। তবে ব্যান্ডের পাঁড় ভক্তরা এসব নিয়ে চিন্তিত নন। গ্যালাগার ভ্রাতৃদ্বয় মঞ্চে গাইবেন আর কৈশোরে শোনা তুমুল জনপ্রিয় গানগুলোর সঙ্গে গলা মেলাবেন, এ আশাতেই অপেক্ষার প্রহর গুনছেন ভক্তরা।