
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে ভারতীয় মিডিয়াতে যখন প্রতিদিন বিভিন্ন গুজব ছড়ানো হচ্ছে, তখনই অন্যরকম গল্প শোনালেন পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় শিল্পী খরাজ মুখোপাধ্যায়। সেই গল্পে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কথা উঠে এসেছে।
ভারতের সংবাদ প্রতিদিন নামের একটি সংবাদ মাধ্যমের ইউটিউব চ্যানেলে খরাজ তার বাংলাদেশ সেনা সদস্যদের আতিথেয়তার গল্প শুনিয়েছেন। খরাজ মুখার্জি নামে একটি ফেসবুক পেজেও ভিডিওটি প্রচার করা হয়েছে।
বাস্তবে খুবই মজার মানুষ এই খরাজ। তার ঝুলিতে আছে অজস্র ফিল্মি গপ্পো। আর বাংলাদেশের সেনা সদস্যদের আতিথেয়তার সেই গল্প এমনই এক ফিল্মি গপ্পোর অংশ।
সম্প্রতি খরাজের একটি ভিডিও শেয়ার করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম সংবাদ প্রতিদিন। ওই ভিডিওতে খরাজকে বলতে শোনা যায়, বেশ কিছু বছর আগের ঘটনা। বাংলাদেশে অঙ্গার ছবির শুটিং করতে গিয়েছিলাম। ওখানকার বান্দরবান এলাকায় শুটিং হয়েছিল। এই শুটিংয়ে আমাদের একজন প্রোডাকশন ম্যানেজার ছিল, নাম উজ্জ্বল। উজ্জ্বল একটু প্রয়োজনের বেশি কথা বলে। তারফলে অনেক কিছুই ভুলভাল বলে। অনেক কিছু গোলমাল হয় সেই কারণে। আমরা যেদিন বান্দরবান যাচ্ছি, সেদিন উজ্জ্বল আমাকে বলল, দাদা খুব সাবধান। এই জায়গা কিন্তু সমস্ত জঙ্গিদের ডেরা। এসব জায়গায় প্রচুর পুলিশ এবং সেনাবাহিনী থাকে। সেনাবাহিনী সব সময় টহল দিতে থাকে, খুব সাবধান। এসব জায়গাতে বেশি কথা বলা যাবে না কিন্তু। আমাদের সময়মতো নেমেও চলে আসতে হবে। একদম টাইমে টাইম মাপা। শুটিং সেরে সময়মতো নেমে আসতেই হবে। আমি উজ্জ্বলকে জিজ্ঞাসা করলাম, ওখানে টয়লেট আছে তো? উজ্জ্বল বলে উঠল, ওটা নেই। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এতক্ষণের কাজ, যদি টয়লেট যেতে হয় তাহলে! আমাকে পাল্টা উজ্জ্বল বলল, একটা জায়গা ঘিরে দেয়া হবে। সেখানেই যেতে হবে। উজ্জ্বলের মুখে এমন কথা শুনে আমি তো চিন্তায় পড়ে গেলাম। এতক্ষণের শুটিং, যদি টয়লেট পেয়ে যায়, কী হবে? আমাদের সমস্যার থেকেও বেশি, নারীরা কী করবে? এই ছবির নায়ক ছিলেন ওম। আর নায়িকা বাংলাদেশের। একেবারেই নতুন। এটাই ছিল ওর প্রথম ছবি। দুচারদিন ধরে ছবির শুটিং চলে।
খরাজের কথায়, প্রথমদিন শুটিং করতে যাচ্ছি। গাড়িটা পাহাড়ি রাস্তা ধরে উপরে উঠছে। কিছুটা যাওয়ার পর আমি উজ্জ্বলকে বললাম, আমার টয়লেট পেয়েছে। উজ্জ্বল আমাকে বলল, একদম না দাদা। খবরদার না। আমি তো অবাক। বলেই ফেললাম, এর মানে কী? তবে উজ্জ্বল বলেই চলল, গাড়ি থেকে একদম নামা যাবে না। আমি বললাম, কেন? উজ্জ্বল আমাকে বলতে শুরু করল, আপনাকে বললাম না, বুঝতে পারছেন না! গাড়ি থেকে নামলেই সেনারা গুলি করে দেবে! আমি ভাবতে শুরু করলাম, এত মহামুশকিলে পড়া গেল। টয়লেট পেয়েছে, কী করব? আরেকটু উপরে ওঠার পর, টয়লেট আর চেপে রাখতে পারছিলাম না। আবার উজ্জ্বলকে বললাম, গাড়ি থামাতে। চোখ বড় বড় করে উজ্জ্বল আবার বলল, একদম না। আপনি বুঝতেই পারছেন না কী বলছি, ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না কেন? এখানে বলে রাখি, উজ্জ্বলের গায়ের রং খুব কালো ছিল। তাই আমরা সবাই কালি বলেই ডাকতাম।
যা ঘটেছিল সেনা চেকপোস্টে
এরপর খরাজ যা জানান তা আসলে বিভিন্ন নেতিবাচক সমালোচকদের চমকে দেয়ার মতো তথ্য।
তিনি বলেন, আমাদের গাড়ি একটা চেকপোস্টের সামনে এসে দাঁড়ায়। সেখানে সেনারা এসে গাড়ির নানা কাগজপত্র পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখছে। আমি তখন ভাবছি, এই সময় যদি গাড়ি থেকে নেমে টয়লেটটা করা যেত, তাহলে খুব ভালো হতো। ওই চেকপোস্টের যিনি দায়িত্বে, সেই অফিসার হঠাৎ মোটা গলায় গাড়ির সামনে এসে জিজ্ঞাসা করছেন, গাড়িতে কে কে আছেন? উজ্জ্বলকে জিজ্ঞাসা করতেই উজ্জ্বল জানাল, আমরা কারা, কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি। আমি গাড়ির সামনের সিটে বসে ছিলাম। আমার দিকে সেই সেনা কর্তার চোখ পড়তেই বলে উঠলেন, আপনি এখানে কী করছেন? আমি বললাম, এই ছবিতে আমিও অভিনয় করছি। শুটিং করতে যাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি ইন্ডিয়ায় থাকেন না? আমি হ্যাঁ বলতেই, সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বলল, গাড়ি থেকে নামুন। আমি তো ভাবলাম, কী অপরাধ করলাম? যে আমাকে এভাবে গাড়ি থেকে নামতে বলছে! আমি গাড়ি থেকে নামলাম।
তারপর অফিসার আমাকে বললেন, চলুন আমার সঙ্গে। আমি বললাম কেন? অফিসার বললেন, আমি বলছি যখন, তখন চলুন। তারপরই হঠাৎ করে অফিসার বলেন, চলুন না, আমার সঙ্গে এককাপ কফি খেয়ে তারপর শুটিংয়ে যাবেন। সেই সুযোগেই আমি বললাম, আমার একটু টয়লেট যেতে হবে। অফিসার বললেন, সে টয়লেট না হয় যাবেন। কফি খাবেন, তারপরই শুটিং করতে যাবেন। আমি জানালাম, এতে শুটিংয়ের দেরি হবে। বরং শুটিং সেরে সন্ধ্যাবেলায় ফেরার সময় কফি খাব। অফিসার তো নাছোড়বান্দা। আমার হাত ধরে কফি খাওয়ার অনুরোধ করেই যাচ্ছেন। আমি বললাম, আমি কথা দিচ্ছি, ফেরার সময় আমি নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে কফি খাব। আপাতত, এখন আমি টয়লেটে যেতে পারি? হঠাৎই শুনতে পেলাম, উজ্জ্বলকে ব্যঙ্গ করে সবাই গাইছে, ব্যাটার নাকে কালি, ব্যাটার মুখে কালি। তারপর টয়লেট করে এসে, আবার অফিসারকে বললাম, আমি ফেরার সময় অবশ্যই কফি খাব আপনার সঙ্গে। দুম করে অফিসার আমাকে বলেন, শুটিংয়ের সময় কোনো অসুবিধা হলে চলে আসবেন। ঘরের ব্যবস্থা করে দেবো। শুয়ে থাকবেন এখানে।
খরাজ এই ভিডিওতে আরও বলেন, সেই সুযোগে আমি অফিসারকে বলেই ফেললাম, আচ্ছা, ওখানে শুটিং করার সময়টা তো খুবই মাপা। যদি একটু বেশি সময় লাগে, ৭টার বদলে যদি সাড়ে ৭টা হয়ে যায়, তাহলে কি খুব অসুবিধা হবে? অফিসার স্পষ্ট বলেন, না কোনো অসুবিধা নেই, যতক্ষণ খুশি করবেন। রাত ১১টা পর্যন্তও করতে পারেন। আমি আছিতো, নিশ্চিন্তে শুটিং করতে পারেন। তারপর গাড়িতে উঠেই উজ্জ্বলকে একহাত নিলাম, সোজা বললাম, তুই তো কথা বেশি বলিস, তুই তো বলেছিলি সন্ধ্যা ৭টা। আমি দেখ, অফিসারের সঙ্গে কথা বলে, ৭টার বদলে রাত ১০টা, ১১টা করে ফেললাম। শুটিং শেষে ফেরার সময় আমি কথা রেখেছিলাম। সেই অফিসারের সঙ্গে কফিও খেয়েছিলাম। কথায় কথায় জানতে পেরেছিলাম, উনি আমার অভিনীত প্রচুর ছবি দেখেছেন। আমাকে পছন্দও করেন। এরপর যতদিন শুটিং চলেছে, রোজই ফেরার পথে অফিসারের সঙ্গে দেখা করতাম। সেই অভিজ্ঞতা ভোলার নয়।
তিনি বাংলাদেশি সেনা সদস্যদের প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে ভিডিওতে বলেন, ‘আসলে সেনাবাহিনী বলতেই সাধারণত অবাঙালিই বেশি দেখেছি। ওখানে গিয়ে ওদের বড্ড আপন লেগেছিল। আসলে একই ভাষায় কথা বলিতো।’