রাজধানীসহ সারা দেশে জেকে বসেছে শীত। ঘন কুয়াশার সঙ্গে বইছে কনকনে ঠান্ডা বাতাস। বৃষ্টির মতো পড়ছে শিশির। হিমেল হাওয়ায় কাঁপছে দেশ। শুক্রবারও ভোর থেকে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘন কুয়াশা দেখা গেছে। এ কারণে দেখা মেলেনি সূর্যের। তাতে শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে। জনজীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। শীতে কাবু হয়ে পড়েছে শিশু ও বয়স্করা। সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবীরা।
রিকশাচালক, দিনমজুরসহ নিম্ন-আয়ের মানুষের ভোগান্তির মাত্রা বেশি। ঘন কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল এবং অভ্যন্তরীণ নদী পরিবহণ ও সড়ক যোগাযোগ সাময়িকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত এমন পরিস্থিতি থাকতে পারে। এরপর সূর্যের দেখা মিলতে পারে। তবে চলতি মাসে আবহাওয়া অনেকটা এমনই থাকবে। যদিও শীতের উপস্থিতি কমবেশি হবে। এছাড়া এ মাসে অন্তত দুটি তীব্র থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কা রয়েছে। তীব্র শীতের কারণে ঠান্ডায় শিশু ও বৃদ্ধদের বাড়তি যত্ন নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
আবহাওয়াবিদ খন্দকার হাফিজুর রহমান বলেন, কুয়াশা আরও কয়েকদিন থাকবে। এরপর যখন কুয়াশা কমে যাবে, তখন দিনের তাপমাত্রা বাড়বে। এখন যে তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে, শীতের সেই তীব্রতা কমে আসবে। রাতের তাপমাত্রা হয়তো কমে যাবে; কিন্তু এমন তীব্র শীত নাও থাকতে পারে।
এদিকে শুক্রবার দেশে সর্বনিু তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে তেঁতুলিয়ায় ৮.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃহস্পতিবার দেশে সর্বনিু তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল চুয়াডাঙ্গায় ৯.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকার সর্বনিু তাপমাত্রা ছিল ১৩ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা বৃহস্পতিবার ছিল ১৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, নওগাঁ, কুষ্টিয়া ও রংপুর বিভাগে বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। রংপুর বিভাগের জেলার সংখ্যা ৮। তাই সব মিলিয়ে ১৩ জেলায় শৈত্যপ্রবাহ ছিল। তবে শুধু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়া জেলাগুলোতেই নয়, রাজধানীসহ দেশের প্রায় সর্বত্রই তীব্র শীতের প্রকোপ ছিল। আবার যেসব এলাকায় রোদ উঠেছে, সেখানেও তীব্রতা কমেনি শীতের। এ কারণে জনজীবনে অনেক স্থানেই নেমে এসেছে স্থবিরতা।
শুক্রবার ছুটির দিন এমনিতেই রাজধানীর রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল কম থাকে। তীব্র শীত তা আরও কমিয়ে দিয়েছে। নিম্ন-আয়ের মানুষের বিপত্তি বেড়েছে; কারণ, তাদের এই শীতেও কাজের সন্ধানে বাইরে বেরোতে হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বালিয়ে উষ্ণতা নিতে দেখা গেছে। ঘন কুয়াশার কারণে যানবাহন চলাচলে বিপত্তি দেখা দিয়েছে অনেক স্থানে। শীতজনিত নানা অসুখে হাসপাতালসহ চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোয় রোগী বেড়েছে।
রাজধানীর রামপুরা এলাকায় রমজান আলী নামের মাঝ বয়সি এক রিকশাচালক বলেন, ভোর ৬টায় বের হয়েছি। সারা দিন সূর্যের দেখা নেই। রাস্তায় যাত্রী কম।
মিরবাগ এলাকায় ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করেন রহমত হোসেন। তিনি বলেন, রোদ আর শীত নয়, ১২ মাসই সকালে বের হতে হয়। কাজ না করলে তো আর আমাদের চলবে না।
এদিকে আজকের আবহাওয়া পূর্বাভাবে বলা হয়েছে, অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারা দেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারা দেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে এবং তা কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। ঘন কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নদী পরিবহণ এবং সড়ক যোগাযোগ সাময়িকভাবে ব্যাহত হতে পারে। সারা দেশে রাত এবং দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে। ঘন কুয়াশার কারণে সারা দেশের কোথাও কোথাও দিনে শীতের অনুভূতি বিরাজ করতে পারে।
ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর
বরিশাল ও আগৈলঝাড়া: ঠান্ডাজনিত কারণে রোগীর চাপ বেড়েছে হাসপাতালে। চারদিনে বরিশাল সদর হাসপাতালে ১০০ জনের বেশি ডায়রিয়ার রোগী ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া শেবাচিম হাসপাতালে শিশু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ। তবে রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতালের উপপরিচালক মনিরুজ্জামান শাহিন।
বরিশাল আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত বরিশালে সর্বনিু ১৩ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
রাজশাহী: চারঘাট উপজেলার ইউসুফপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম মাখন বলেন, আমার ইউনিয়নের অধিকাংশ বাসিন্দা পদ্মাপারে বসবাস করে। একটু বাতাসেই তীব্র শীত অনুভব হয়। দুই সপ্তাহ ধরে শুনছি কম্বলের বরাদ্দ এসেছে, কিন্তু এখনো হাতে পাইনি।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ফরহাদ লতিফ বলেন, কম্বলের বরাদ্দ দুই সপ্তাহ আগে পেয়েছি। এতিমখানাসহ কিছু জায়গায় প্রায় ৫০০ পিস বিতরণ হয়েছে। ইউনিয়নপ্রতি ৩০০ পিস হারে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ইউনিয়নগুলোয় তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
বাগেরহাট: জেলায় শুক্রবারও সূর্যের দেখা মেলেনি। তাপমাত্রার পারদ নেমেছে ১২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা এ বছর সর্বনিু। এ পরিস্থিতি আরও দু-একদিন থাকতে পারে বলছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তীব্র শীতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন বোরো ধানচাষি, দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষ। অতিরিক্ত শীতে ধানের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে ধারণা কৃষকদের।
তবে শীতে খেজুরের রসের মান ভালো হচ্ছে। বাগেরহাট শহরের রিকশাচালক রবিউল বলেন, পেটের দায়ে রিকশা নিয়ে বের হয়েছি। শীতে যাত্রী কম, আয়ও কম।
পঞ্চগড় : মৌসুমের সর্বনিু তাপমাত্রায় কাঁপছে জেলাটি। শুক্রবার সকাল ৯টায় তেঁতুলিয়ায় দেশের সর্বনিু তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। বয়ে চলেছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। বৃহস্পতিবার তেঁতুলিয়ায় সর্বনিু তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিরূপ আবহাওয়ায় পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শিশু ও বয়স্করা সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগে প্রতিদিন অনেক রোগী আসছে। তাদের অনেককেই প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর যাদের অবস্থা কিছুটা খারাপ, তাদের হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
দিনাজপুর: জেলায় শুক্রবার সর্বনিু তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দিনাজপুর রেলওয়ে স্টেশন চত্বরে আবুল হোসেন নামে একজন বলেন, সারা দিন শহরে ভিক্ষা করি। রাতে রেলওয়ে স্টেশনে কোনোমতে কাটাই। কিন্তু গত কয়েকদিন তীব্র শীতে রাতে ঘুমাতে পারছি না।
বিরল উপজেলার আজিমপুর গ্রামের কৃষিশ্রমিক কমলেশ চন্দ্র রায় বলেন, একদিন মাঠে কাজ না করলে পরিবারের আহার জোটে না। এজন্য বাধ্য হয়েই প্রতিদিন অপরের জমিতে কাজ করতে হয়। কিন্তু গত কয়েকদিন তীব্র শীতে ফসলের মাঠে কাজ করা অনেকটা অসাধ্য হয়ে পড়েছে।
শেরপুর : তিনদিন পর শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে সূর্যের উত্তাপে মানুষের মনে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। তবে বিকালে ঠান্ডার তীব্রতা আবারও বেড়ে যায়। হিমেল হওয়ায় দুর্ভোগে সব শ্রেণির মানুষ। তবে ছিন্নমূল ও শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট বেশি।
টাঙ্গাইল : জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামাল উদ্দিন বলেন, শুক্রবার জেলার সর্বনিু তাপমাত্রা ১১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯৩। এ অবস্থা আরও কয়েকদিন থাকতে পারে।
শহরের নতুন বাসস্ট্যান্ডে রিকশাচালক আবেদ আলী বলেন, স্বাভাবিক সময়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় করলেও বৃহস্পতিবার শীত থাকায় শহরে লোকজন কম বের হয়েছে। এতে ৪০০ টাকার মতো আয় হয়েছে।
কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) : কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ বাজারে গরম কাপড়ের দোকানগুলোয় শীতের কাপড় কিনতে ভিড় করেছে নারী-পুরুষ। সেখানে ২০ থেকে ৩ হাজার টাকায় শীতবস্ত্র বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ী সোহান আহমেদ জানান, এ বছর ভালোমানের শীতের কাপড় এসেছে। ক্রেতারা উন্নতমানের শীতবস্ত্র পেয়ে খুশি।
কয়রা (খুলনা): শুক্রবার সকাল থেকে উপজেলার বিভিন্ন স্থান ঘুরে রাস্তা, হাটবাজারে মানুষের উপস্থিতি তেমন দেখা যায়নি। কুশোডাংগা গ্রামের ভ্যানচালক মো. আসাদুল ইসলাম বলেন, ভ্যান নিয়ে রাস্তায় এসেছি, এখনো ভাড়া পাইনি। জায়গীর মহল হাসপাতাল মোড়ের চা বিক্রেতা মো. দবির উদ্দীন বলেন, ভোরে দোকান খুলেছি। ঠান্ডায় লোকজনের দেখা মিলছে না।
কয়রা সদরের দরজি রবিউল ইসলাম বলেন, সকাল থেকে এখনো একটা কাজও করতে পারিনি। এদিকে গিলাবাড়ি খেয়াঘাটের মাঝি আ. সালাম জানান, সকাল থেকে লোকজনের খেয়া পারাপার খুব কম। তাই আয় নেই।