বন বিভাগ, ইজারাদার কর্তৃপক্ষ ও উপজেলা প্রশাসনের নানা পদক্ষেপের পরও পর্যটকের মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না মিরসরাইয়ের পাহাড়ি ঝরনাগুলোতে। নানা অসচেতনতায় গত দেড় মাসেই উপজেলার খৈয়াছড়া ও রূপসী ঝরনা দুটিতে বেড়াতে এসে ছয় পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। নিহত পর্যটকদের বেশির ভাগই বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
গত শনিবার দুপুরে সরেজমিনে মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনায় গিয়ে দেখা যায়, ঝুঁকি নিয়ে পাহাড় বেয়ে ঝরনার ওপর উঠছেন কিছু পর্যটক। ইজারাদারের পক্ষে নিয়োগ করা গাইড মাইক দিয়ে বারবার তাঁদের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের ওপরে উঠতে নিষেধ করলেও তা শুনছেন না পর্যটকেরা।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের আওতায় বারিয়ারঢালা জাতীয় উদ্যানের ২ হাজার ৯৩৫ একর পাহাড়ি এলাকায় খৈয়াছড়া, রূপসী, সোনাইছড়ি, নাপিত্তাছড়া ও বাওয়াছড়া ঝরনাগুলোর অবস্থান। এসব ঝরনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পর্যটক যান খৈয়াছড়া, নাপিত্তাছড়া ও রূপসী ঝরনায়। পর্যটনে শৃঙ্খলা ফেরাতে তিন বছর ধরে এই ঝরনাগুলো ইজারা দিয়ে আসছে বন বিভাগ। এ বছরের ২৮ এপ্রিল থেকে ৩০ লাখ টাকায় ১ বছরের জন্য এসব ঝরনার ইজারা পায় শোমোশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ২০ টাকা মূল্যের টিকিটের বিনিময়ে পর্যটকেরা ঝরনায় যান। সেই আয় থেকেই প্রতিষ্ঠানটি এসব ঝরনার দেখভাল করছে।
বন বিভাগ, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ও রূপসী ঝরনায় গত দেড় মাসে ছয় পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে গত ২০ আগস্ট মঙ্গলবার সকালে খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে এসে ঝরনা এলাকায় বিদ্যুতায়িত হয়ে অঞ্জন বাড়ৈই (২১) ও ফয়সাল হক (২২) নামের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এরপর ৫ সেপ্টেম্বর খৈয়াছড়া ঝরনায় হারিয়ে যাওয়ার ৪২ ঘণ্টা পর ঝরনা এলাকার একটি কূপ থেকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিফাতুর রহমান মজুমদারকে (২১)। সিফাতের পর গত ২৮ সেপ্টেম্বর খৈয়াছড়া ঝরনায় মাথায় পাথর পড়ে মৃত্যু হয় ব্যাংক কর্মকর্তা মাহবুব হাসানের (৩১)। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের ঢাকার প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তা ছিলেন। সর্বশেষ ৪ অক্টোবর দুপুরে মিরসরাইয়ের ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের বড় কমলদহ এলাকার রূপসী ঝরনায় পাহাড় বেয়ে ওঠার সময় পা পিছলে কূপের পানিতে ডুবে মৃত্যু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুশফিকুর রহমান (২১) ও মাহবুবুর রহমানের (২১)। এসব ঝরনায় ঘুরতে এসে গত দেড় মাসে অন্তত আরও চারজন পর্যটক গুরুতর আহত হয়েছেন।
শনিবার দুপুরে মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনা এলাকায় কথা হয় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে বেড়াতে আসা শিক্ষার্থী ফারহান নাইফের সঙ্গে।তিনি বলেন, মিরসরাইয়ের পাহাড়ি ঝরনাগুলো অসাধারণ সুন্দর। কিন্তু এখানে কিছু পর্যটকদের গাফিলতি ও অতি উৎসাহে প্রায় দুর্ঘটনা ঘটছে। গাইড সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণ করলে এসব দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমে যাবে।
জানতে চাইলে ঝরনাগুলোর ইজারাদার প্রতিষ্ঠান শোমোশনের তত্ত্বাবধায়ক মো. মোশারফ হোসেন বলেন, ‘পর্যটকদের নিরাপত্তা বিধানে সব রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি আমরা। তবু অনেক পর্যটক নিষেধ অমান্য করে ঝুঁকি নিয়ে ঝরনার কূপে লাফঝাঁপ ও পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করেন। আমরা এখন পর্যটকদের গাইড সঙ্গে নিয়ে ঝরনা এলাকা ভ্রমণ করতে আরও বেশি উৎসাহিত করছি।’
মিরসরাইয়ের পাহাড়ি ঝরনাগুলোতে যেকোনো দুর্ঘটনায় উদ্ধারকাজে সাড়া দেন ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা। এ বিষয়ে মিরসরাই ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে কর্মকর্তা ইমাম হোসেন পাটোয়ারী বলেন, মিরসরাইয়ের পাহাড়ি ঝরনাগুলো দুর্গম হওয়ায় যেকোনো দুর্ঘটনায় এখানে উদ্ধারকাজ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক সময় পাহাড়ি পথ পেয়ে মৃতদেহ আনতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের জীবনও বিপন্ন হওয়ার হুমকিতে পড়ে। যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে বন বিভাগকে এসব ঝরনায় পর্যটক ভ্রমণ নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত।
মিরসরাইয়ের ঝরনাগুলোতে বেড়াতে এসে পর্যটকদের এমন প্রাণহানির বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বারিয়ারঢালা রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘ঝরনায় ঘুরতে এসে কিছু তরুণ পর্যটক নিষেধ-বারণ কিছুই মানেন না। দুর্ঘটনা এড়াতে ঝরনা এলাকায় সব রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি আমরা। ইজারাদারকেও এ বিষয়ে সব সময় তদারকির মধ্যে রাখা হয়। গাইড নিয়ে ভ্রমণ ও পর্যটকেরা সচেতন হলে এসব দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।’