
দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে ইসরাইলি হামলায় পুড়ছে গাজা। অবিরতভাবে চলছে সেনাদের নৃশংস তাণ্ডব। গা শিউরে ওঠা মৃত্যুর মিছিলেও দমে নেই তারা। গাজায় সহিংসতার ডামাডোলের মধ্যেই পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের ওপরও নির্যাতন চালাচ্ছে ইসরাইলি বাহিনী। সেখানেও পড়েছে সেনাদের ভয়ংকর থাবা। চলছে জোর দখল-লুটপাট। নেই জীবনের নিরাপত্তা। ইসরাইলের ব্যাপক দমন-পীড়নে পশ্চিম তীর থেকেও ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। এপি।
৭ অক্টোবর ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজার পাশাপাশি পশ্চিম তীরেও হামলা চালিয়েছে সেনারা। গাজায় যুদ্ধবিরতি চলাকালীন পশ্চিম তীরে হামলা আরও জোরদার করে তারা। সে তুলনায় এখন একটু কমলেও হামলা অব্যাহত রয়েছে। হত্যা-দখল, মারধর-গ্রেফতারের জেরে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় ইসরাইলি আক্রমণ থেকে পালিয়েছেন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থার তথ্য অনুসারে, চলমান সামরিক অভিযানে ৪০ হাজার ১০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। গাজায় হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাত্র দুইদিন পরই ২১ জানুয়ারি পশ্চিম তীরের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন-পীড়নের ঘোষণা দেয় ইসরাইল। তুলকারেম, ফারা এবং নুর শামসসহ আশপাশের আরও কয়েকটি শহরে জোরপূর্বক প্রবেশ করে। শুরু হয় তাণ্ডব, যা আবার জাগিয়ে তোলে ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের সেই তিক্ত স্মৃতি। সেই যুদ্ধের সময় ইসরাইলের সহিংসতায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তচ্যুত হয়। মঙ্গলবার ইসরাইলি সেনাবাহিনী সালফিট অঞ্চলের কাফর আদ-দিক এবং ব্রুকিন শহরে আক্রমণ চালিয়েছে। বেথলেহেমের দক্ষিণে অবস্থিত ধেইশেহ শরণার্থী শিবিরেও কাঁদানে গ্যাস এবং বোমা নিক্ষেপ করেছে। এ ছাড়া ইসরাইলি বাহিনী নাবলুস শহর এবং নিকটবর্তী বালাতা ও আল-আইন শরণার্থী শিবিরেও এদিন ভোরে অভিযান চালিয়ে আট ফিলিস্তিনিকে আটক করেছে বলে জানিয়েছে আলজাজিরা।
এর আগে রোববার রাতে অধিকৃত পশ্চিম তীরের সিলাত আল-হারিথিয়া, কালকিলিয়া ও কাতান্না শহরে হামলা চালায় ইসরাইল। স্থানীয় সংবাদ সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, তারা রামাল্লা শহরের কাছে শুকবা ও আল-মুগাইর গ্রামেও হামলা চালিয়েছে। ইতোমধ্যে জেনিন পৌরসভা ঘোষণা করেছে, ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পের প্রায় ৬৬টি ভবন ভাঙার অতিরিক্ত আদেশ জারি করেছে। যার মধ্যে প্রায় ৩০০টি আবাসিক ইউনিট রয়েছে। কয়েকদিন আগেও দখলদার বাহিনী ধনাবার শহরতলির আল-আজাব ও ইকতাবাতে হামলা চালিয়েছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি বাড়িতে অভিযান ও তল্লাশি চালিয়ে তিন যুবককে গ্রেফতার করে। বর্বর সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরাও সমান তালে তাণ্ডব চালাচ্ছে পশ্চিম তীরের অসহায় ফিলিস্তিনিদের ওপর।
সোমবার ইসরাইলি অধিকার গোষ্ঠী পিস নাউয়ের বরাত দিয়ে আলজাজিরা জানিয়েছে, অধিকৃত পশ্চিম তীরের হেবরনের তেল রুমেইদাতে একটি ফিলিস্তিনি পরিবারের বাড়িতে জোরপূর্বক ঢুকে পড়ে বসতি স্থাপনকারীরা। সেখানে একটি নতুন বসতি স্থাপন করে। এটি ঘটে যখন ফিলিস্তিনি পরিবারটি রমজানের রোজা ভাঙতে ইফতারের জন্য বাইরে গিয়েছিল। পরিবারটি ফিরে আসার পর ইসরাইলি সেনাবাহিনী তাদের বাড়ির কাছে যেতে বাধা দেয়। পুলিশ অভিযোগ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। বসতি স্থাপনকারীরা মিথ্যা দাবি করেছে যে তারা বাড়িটি কিনেছে। এভাবেই চলছে জোরপূর্বব দখল। কখনো কখনো বুলডোজার ব্যবহার করেও চলছে উচ্ছেদ কার্যক্রম। তারা শুধু অবৈধভাবে জায়গাই দখল করছে না, বরং সহিংসতাও চালাচ্ছে সেখানে।
একটি সরকারি প্রতিবেদন অনুসারে, ১০ বছরে অবৈধ ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরা অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ৫ হাজারেরও বেশি সহিংসতা চালিয়েছে।
শনিবার প্রকাশিত প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের ন্যাশনাল ব্যুরো ফর ল্যান্ড ডিফেন্স অ্যান্ড সেটেলমেন্ট রেজিস্ট্যান্স কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনিদের ওপর পাথর নিক্ষেপ, তাদের বাড়িঘর এবং যানবাহনের ওপর পাথর নিক্ষেপ, পাশাপাশি বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, খামার ও অন্যান্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি লক্ষ্য করে অগ্নিসংযোগের ঘটনাসহ অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের ওপর বিস্তৃত লঙ্ঘনের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য লঙ্ঘনের মধ্যে জলপাই গাছ ধ্বংস, পানির সরবরাহের অবকাঠামো ধ্বংস, গবাদি পশু চুরি ও হত্যা এবং বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব সহিংসতার মধ্যেই আবার ১৩টি অবৈধ বসতিকে স্বাধীন হিসাবে স্বীকৃতি দিল ইসরাইল।
রোববার দেশটির অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ বলেছেন, ‘এই বসতিগুলো এখন স্বাধীন হিসাবে স্বীকৃত হবে। আমরা বসতির স্বাভাবিকীকরণ এবং নিয়মিতকরণের বিপ্লব চালাচ্ছি। এটি ইহুদি ও সামারিয়া অঞ্চলে প্রকৃত সার্বভৌমত্বের পথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’ তবে এর নিন্দা জানিয়েছে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার ইসরাইলের এ পরিকল্পনার নিন্দা জানিয়েছে কাতারও। দেশটির মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, যে কোনো ধরনের ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুতি আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। মিসর, জর্ডান ও সৌদি আরবও ইসরাইলি পরিকল্পনার নিন্দা জানিয়েছে।