
টাঙ্গাইলে ঐতিহ্যবাহী জামাই মেলা শুরু হয়েছে। তিন দিনব্যাপী এ মেলার শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) ছিল প্রথম দিন। উদ্বোধনী দিনেই মেলা জমে উঠেছে। এ মেলার ইতিহাস প্রায় দেড়শ বছর পুরোনো। এর ধারাবাহিতায় টাঙ্গাইল সদর উপজেলার রসুলপুর গ্রামে মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মেলাকে কেন্দ্র করে এলাকায় উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। দূরদূরান্ত থেকে জামাইরা মেলায় এসেছেন।
জানা যায়, মেলাকে সামনে রেখে ছোট ছেলে মেয়েদের জন্য আয়োজন করা হয়েছে নানা বিনোদনের ব্যবস্থা। মেলায় এবার বিভিন্ন ধরনের খেলনা, কসমেটিকস, খাবারের দোকানসহ প্রায় ৩০০ স্টল বসেছে। ঐতিহ্যবাহী এই মেলায় ব্যবসা করতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছেন ব্যবসায়ীরা। মেলাকে কেন্দ্র করে এলাকায় ঈদ বা পূজা-পার্বনের থেকেও উৎসবমুখর ও আনন্দঘন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর ১১, ১২ ও ১৩ বৈশাখ (সনাতন পঞ্জিকা অনুসারে) টাঙ্গাইলের সদর উপজেলার রসুলপুর বাছিরন নেছা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আয়োজন করা হয় এই মেলার। তিনদিনে রসলপুরসহ আশেপাশের অন্তত ৩০-৩৫টি গ্রামের হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে মেলায়। বিশেষ করে মেলাকে কেন্দ্র করে এলাকার সব মেয়ের জামাই শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে আসেন। এ কারণেই প্রথম দিন মেলাটি জামাই মেলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। জামাইয়ের হাতে কিছু টাকা দেন শাশুড়িরা। আর সেই টাকার সঙ্গে আরও টাকা যোগ করে জামাইরা মেলায় গিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র ক্রয় করেন। পরদিন (দ্বিতীয় দিন) মেলায় বাড়ির বউদের ব্যাপক সমাগম ঘটে। তারা জামাইসহ আত্মীয়স্বজন নিয়ে আসেন। সে কারণে বউ মেলা হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে। তৃতীয় দিন সব শ্রেণীর লোকজনের আগমনের মধ্যদিয়ে মেলার সমাপ্তি ঘটে।

শুক্রবার বিকেলে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, মেলায় দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। মিষ্টি জাতীয় দোকানের সংখ্যা বেশি লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়াও বিনোদনের জন্য নাগরদোলা, মোটরসাইকেল খেলাসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা ছিল। বড়দের পাশাপাশি ছোট ছেলেমেয়েরা এ মেলা উপভোগ করে।
রসুলপুরের বাসিন্দা ও কথাসাহিত্যিক রাশেদ রহমান বলেন, এই মেলার উৎপত্তি কবে সেটা কেউ জানে না। যুগ যুগ ধরে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে। মেলাটি দেড়শ বছরের। এই এলাকার মানুষের কাছে ঈদ আর পূজাপার্বনের থেকেও এই মেলা বেশি উৎসবের। মেলাটি বৈশাখি মেলা হিসেবে ব্রিটিশ আমলে শুরু হলেও এখন এটি জামাই হিসেবে পরিচিত। মেলাকে সামনে রেখে রসুলপুর ও এর আশেপাশের বিবাহিত মেয়েরা তাদের বরকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসেন। আর মেয়ের জামাইকে মেলা উপলক্ষে বরণ করে নেবার জন্য শ্বশুর-শাশুড়িরা বেশ আগে থেকেই নেন নানা প্রস্তুতি। মেলার দিন জামাইয়ের হাতে কিছু টাকা তুলে দেন শাশুড়িরা। আর সেই টাকার সঙ্গে আরও টাকা যোগ করে জামাইরা মেলা থেকে চিড়া, মুড়ি, আঁকড়ি, মিষ্টি, জিলাপিসহ বিভিন্ন জিনিস কিনেন। মেলার দ্বিতীয় দিন বাড়ির বউদের সমাগম বেশি ঘটে।
আফজাল হোসেন নামের এক জামাই বলেন, শাশুড়ি দাওয়াত দিয়েছেন। তাই মেলায় এসে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের জন্য ৪০ কেজি মিষ্টি কিনেছি। গত কয়েক বছর ধরে মেলায় এসেছি। অন্য বছরের চেয়ে এবার মেলা জমজমাট বেশি মনে হচ্ছে।

দেলদুয়ার থেকে আসা মো. নাসির মিয়া নামের এক দর্শনার্থী বলেন, পরিবার নিয়ে মেলায় ঘুরতে এসেছি। মেলায় এলে মানুষের সঙ্গে সম্প্রীতি বাড়ে। এমন মেলা সারাদেশেই হোক। এর মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্প্রীতি বজায় থাকে। এতে আমরা একে অপরের সাথে মিশতে ও দেখা করতে পারি।
মাসুদ রানা নামের এক দর্শনার্থী বলেন, মেলাটি আমাদের টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য। উৎসবমুখরভাবে আমরা মেলা উদযাপন করি। মেলার পরিবেশ অনেক সুন্দর।
স্থানীয় আব্দুল মান্নান বলেন, বহু বছর ধরে আমাদের এখানে মেলা হচ্ছে। মেলা উপলক্ষে জামাইদের দাওয়াত করা হয়। জামাইরা এসে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের জন্য মেলা থেকে অনেক কিছু কিনে নিয়ে যায়।
সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থেকে আসা মিষ্টি ব্যবসায়ী আকবর আলী বলেন, বৃহস্পতিবার এসেছি। আশানুরূপ বিক্রি হয়নি। তবে আশা করছি সামনে আরো ভালোই বিক্রি হবে।
গোপাল ঘোষ নামের এক মিষ্টি ব্যবসায়ী বলেন, এখন পর্যন্ত লাখ টাকার মতো বিক্রি হয়েছে। আমি চমচম, কালোজাম, বেবি সুইট, মালাইকারি ইত্যাদি মিষ্টি নিয়ে এসেছি।

তাপস চন্দ্র সাহা নামের এক আঁকড়ি ব্যবসায়ী বলেন, মেলায় দীর্ঘদিন ধরে আসছি। আমি আঁকড়ি ছাড়াও মিষ্টি জাতীয় জিনিস নিয়ে এসেছি। ভালোই বিক্রি হচ্ছে।
এ বিষয়ে মেলা কমিটির আহ্বায়ক ও গালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম খান বলেন, এ মেলাটি প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো। মেলার মূল আকর্ষণ মিষ্টি জাতীয় খাবার। এখানে বিভিন্ন ফানির্চার বিক্রি হয়। এ মেলাটি জেলার সব চেয়ে বড় মেলা।
তিনি আরও বলেন, মেলায় প্রায় ছোট বড় মিলিয়ে ৩ শতাধিক দোকান বসেছে। মেলা শুরু হওয়ার আগেই গ্রামের জামাই ও বউয়েরা আসেন। তারা বিভিন্নভাবে মেলা উপভোগ করে থাকেন। এছাড়া মেলায় জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন আসেন। মেলা উপলক্ষে আমাদের প্রায় দেড় শতাধিক লোক ভলানটিয়ার হিসেবে কাজ করছেন। আমরা দোকানদারকে সার্বিক সহযোগিতা করছি।