রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আহ্বান বাড়ছে। তবে শান্তি চুক্তির ক্ষেত্রে নিজেদের শর্ত নিয়ে অনেকটা গোঁ ধরে বসে আছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। কেউ ছাড় দিতে চাচ্ছেন না। এরই মধ্যে আবার রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা চালাতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কাছে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছে কিয়েভ। এ অনুমতি পেলে যুদ্ধ বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। সব মিলিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধ কোন দিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে লিখেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাজন মেনন।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আড়াই বছর পার হলো। একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির মাধ্যমে এ যুদ্ধ থামানোর আহ্বান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাড়ছে। তবে শান্তি চুক্তির জন্য মস্কো ও কিয়েভ যেসব শর্ত দিয়েছে, সেগুলো এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এরপর ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চল দখলে নিয়েছে মস্কো। শান্তি চুক্তির শর্ত হিসেবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি শুধু এই অঞ্চলগুলোই ফেরত চান না, ২০১৪ সালে রাশিয়া দেশটির যেসব অঞ্চল দখলে নিয়েছিল, সেগুলোও ফেরত চান।
আর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দাবি হলো, ইউক্রেনে চারটি অঞ্চল—দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসনকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। ইউক্রেন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হোক, তা-ও চান না তিনি। এ ছাড়া দেশটির সেনাসংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্রেও লাগাম টানতে চান পুতিন।
পুতিন ও জেলেনস্কি—দুই নেতাই প্রকাশ্যে বলেছেন, তাঁরা সমঝোতা আলোচনার জন্য প্রস্তুত। তবে কেউই নিজেদের লক্ষ্যগুলো থেকে সরে আসছেন না বা জয়ের আশা ছাড়ছেন না। এমন পরিস্থিতিতে বর্তমানে যুদ্ধের মূল কেন্দ্র দোনেৎস্কে এগিয়ে চলেছে রুশ বাহিনী। তাদেরও বহু সেনাসদস্য মারা যাচ্ছেন এবং সরঞ্জামের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। হুমকির মুখে পড়ছে প্রধান শহরগুলো।
এরই মধ্যে গত মাসে হঠাৎ রাশিয়ার কুরস্ক প্রদেশে অভিযান শুরু করে ইউক্রেন বাহিনী। এ প্রদেশের প্রায় ৫০০ বর্গমাইল এলাকা দখল করে নেয় তারা। সারা বছর লড়াই করেও দোনেৎস্কে এ পরিমাণ অঞ্চল দখলে নিতে পারেনি রুশ বাহিনী। কুরস্কে ইউক্রেনের ওই আচমকা অভিযান মস্কোকে অনেকটা হকচকিয়ে দিয়েছিল।
এদিকে রাশিয়ার ভেতরের অঞ্চলে এটিএসিএমএস ও স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালাতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কাছে অনুমতি চেয়েছে ইউক্রেন। এ অনুমতির বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে দেশ দুটি। ইউক্রেনের হাতে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দুটি রয়েছে। নিজেদের ভূখণ্ডে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে সেগুলো ব্যবহার করেছে তারা।
রাশিয়ার কুরস্কে ইউক্রেনের আচমকা অভিযান মস্কোকে অনেকটা হকচকিয়ে দিয়েছিল।
তবে পুতিন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ওয়াশিংটন ও লন্ডনের অনুমতির অর্থ হলো তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এর পরিণতি হবে ধ্বংসাত্মক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দীর্ঘদিনের যুদ্ধে সেনাসদস্যের মধ্যে যে গ্লানি এসেছে এবং সংঘাত আরও বেড়ে যাওয়ার যে শঙ্কা দেখা দেখা দিয়েছে, তা যুদ্ধ বন্ধের জন্য সমঝোতার পথ তৈরি করবে কি না। বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
ইউক্রেনীয়রা নিশ্চিতভাবে প্রচণ্ড রকমের দুর্দশা সহ্য করেছে। তাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশের নিরাপদ অঞ্চল বা বিদেশে আশ্রয় নিতে হয়েছে এক কোটি মানুষকে। ইউক্রেনের সেনাসদস্য ও অস্ত্রের সংখ্যা কমে গেছে। চলতি বছরের প্রথমার্ধে তা একেবারে তলানিতে পৌঁছেছিল। এখন রুশ বাহিনীকে সামাল দিতে নতুন সেনাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ইউক্রেন।
এ ছাড়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও গত এপ্রিল পর্যন্ত জিইয়ে ছিল। এরপর কিয়েভকে ৬ হাজার ১০০ কোটি ডলারের সহায়তা অনুমোদন দেয় মার্কিন কংগ্রেস। এর মধ্যে ২ হাজার ৫৭০ কোটি ডলার সামরিক সহায়তা। সহায়তা ছাড়ে এই বিলম্বের কারণে ইউক্রেন বাহিনীতে অস্ত্র–সরঞ্জামের তীব্র ঘাটতি দেখা দেয়। এ সুযোগে দোনেৎস্কে ইউক্রনীয় বাহিনীর হাত থেকে অনেক এলাকা দখল করে নেয় মস্কো।
ইউক্রেনের মূল সমস্যাটি হলো বড় পরিসরে কৌশলগত যুদ্ধ পরিচালনা করার সক্ষমতার অভাব। দূরপাল্লার ক্ষেপাণাস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি ইউক্রেনের এ সমস্যার সমাধান করবে না। তবে জেলেনস্কি মনে করেন, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ভয় পাচ্ছে। এ নিয়ে হতাশ তিনি। যুদ্ধ বেড়ে যাওয়ার চেয়ে পরাজয়ের ভয় এখন বেশি পাচ্ছেন জেলেনস্কি।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেন পরাজিত হোক—লন্ডন ও ওয়াশিংটন তা চায় না। অপর দিকে যুদ্ধের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া ঠেকানোর বিষয়েও তারা দৃঢ়সংকল্প। কারণ, এর জেরে পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হতে পারে। তবে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি না পাওয়া গেলেও হামলায় নিজেদের তৈরি কম সক্ষমতার ড্রোনের ব্যবহার চালিয়ে যাবে ইউক্রেন বাহিনী। এ ছাড়া নতুন একটি রকেট ড্রোনও তৈরি করেছে তারা। ‘পালিয়ানিতসিয়া’ নামের এই ড্রোন দিয়ে দ্রুতগতিতে স্বল্পপাল্লায় হামলা চালানো যায়।
যুদ্ধ বেড়ে যাওয়ার চেয়ে পরাজয়ের ভয় এখন বেশি পাচ্ছেন জেলেনস্কি।
কুরস্কে ইউক্রেন বাহিনীর অভিযানের সফলতা এখনো অনিশ্চিত। একই সঙ্গে এটিএসিএমএস ও স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্তও অজানা। তবে যা-ই হোক না কেন, যুদ্ধ বন্ধে আলোচনার টেবিলে বসার জন্য তাড়াহুড়া করবেন না জেলেনস্কি। চুপ থাকবেন পুতিনও। তিনি এ বিশ্বাস নিয়ে আছেন যে রাশিয়ার জয় হবে। তবে এটাও জানেন, ব্যতিক্রম কিছু হলে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
যুদ্ধ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা এবং যুদ্ধ বন্ধে ক্রমবর্ধমান আহ্বানের মধ্যেও ইউক্রেন ও রাশিয়া নিজেদের পক্ষে যে যুক্তি তুলে ধরছে, তাতে এটাই বোঝা যাচ্ছে যে যুদ্ধ কয়েক মাস বা আরও লম্বা সময় ধরে চলবে। তবে এ পরিস্থিতিতে বদল আসতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার হোয়াইট হাউসে ফিরে এলে। আর সেটা মস্কোর জন্য স্বস্তিদায়ক হলেও কিয়েভের জন্য হবে ভয়ের কারণ।