তিনদিনের বন্যায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় শিশুসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। ১০ উপজেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৫০ হাজার পরিবারের প্রায় তিন লাখ মানুষ। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
কিছু কিছু স্থানে পানি নামতে শুরু করলেও বন্যা পরিস্থিতি এখনো প্রায় অপরিবর্তিত চট্টগ্রামে। পানি নামতে শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির খবর। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ফটিকছড়ি, মিরসরাই, হাটহাজারী উপজেলার বাসিন্দারা।
এখন পর্যন্ত ফটিকছড়িতে শিশুসহ তিনজন, হাটহাজারীতে একজন ও রাঙ্গুনিয়ায় একজনের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারা হলেন- ফটিকছড়ির রজি আহমেদ (৫৫), মো. সামি (৭) ও একজন অজ্ঞাত। রাঙ্গুনিয়ার দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নে পানিতে তলিয়ে বাসিন্দা মো. রনি (১৭) ও হাটহাজারীতে বন্যার পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে জিয়াউর রহমান সাকিব (২২) নামে দুই যুবকের মৃত্যু হয়েছে।
ফটিকছড়ির ইউএনও মোজাম্মেল বলেন, ‘দাঁতমারা, নারায়নহাট ও ভুজপুরে ইউনিয়নের এক শিশুসহ তিনজনের মৃত্যুর খবর আমরা পেয়েছি। তারা বানের পানিতে ভেসে গিয়েছিল।’
এছাড়া মীরসরাই উপজেলার হাইতকান্দি এলাকায় পানিতে ভাসমান অবস্থায় এক অজ্ঞাত তরুণের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
পাহাড়ি ঢল ও হালদা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ফটিকছড়ির দুই পৌরসভাসহ (ফটিকছড়ি ও নাজিরহাট) বাগানবাজার, দাঁতমারা সুন্দরপুর, পাইন্দং, হারুয়ালছড়ি, সুয়াবিল, নারায়ণহাট ও ভূজপুর ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এছাড়া লেলাং, সমিতিরহাট, রোসাংগিরী, জাফতনগর, বক্তপুর, নানুপুর, ধর্মপুরসহ ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে প্লাবিত হয়। পাশাপাশি হাটহাজারীর ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের ছয়টি ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের ঘর-বাড়ি প্লাবিত হয়েছে।
অন্যদিকে ফেনী নদী ও মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার মিরসরাই উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানিতে উপজেলার করেরহাট, হিঙ্গুলী, বারইয়ারহাট পৌরসভা, মিরসরাই পৌরসভার নিম্নাঞ্চল, জোরারগঞ্জ, ইছাখালী, কাটাছরা, দুর্গাপুর, মিঠানালা, খৈয়াছড়া, ওসমানপুর, ওয়াহেদপুরসহ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। একইভাবে হালদা নদীর পানি প্লাবিত হয়েছে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও বোয়ালখালীর বেশ কিছু এলাকা।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের স্টাফ অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমুন নবী বলেন, ‘বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনী ও বিজিবিসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা কাজ করছে। মিরসরাই উপজেলায় ৫০টি এবং ফটিকছড়িতে ১০টি উদ্ধারকারী নৌযান কার্যক্রম চালাচ্ছে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ফটিকছড়ি, মিরসরাই ও ফেনীতে আমাদের সাতটি দল ত্রাণ নিয়ে পৌঁছেছে। তারা ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি উদ্ধার কাজ চালাচ্ছেন। নগরের ষোলশহর রেল স্টেশনে আমরা গণত্রাণ সংগ্রহ করছি।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছাড়াও আল্লামা আবুল খাইর ফাউন্ডেশন, গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন ও রাজনৈতিক দল চট্টগ্রামে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া সাধারণ মানুষও যে যেভাবে পারছেন তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করছেন।
চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ছাইফুল্লাহ মজুমদার বলেন, ‘চট্টগ্রামের ১০ উপজেলায় দুই লাখ ৬২ হাজার ৪০০ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ফটিকছড়ির ২০টি ইউনিয়নে ১৯ হাজার ৫৮০ পরিবারের এক লাখ দুই হাজার; মীরসরাই উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের ১২ হাজার পরিবারের ৪৮ হাজার ৫০০; সীতাকুণ্ডের ছয়টি ইউনিয়নের পাঁচ হাজার পরিবারের ২০ হাজার; হাটহাজারীতে ১২০টি পরিবারের দুই হাজার ৮০০; কর্ণফুলীতে পাঁচটি ইউনিয়নের ১০০টি পরিবারের ৫০০; পটিয়ায় ১৭টি ইউনিয়নের ছয় হাজার ৯৪৬টি পরিবারের ২০ হাজার; বোয়ালখালীতে তিনটি ইউনিয়নে ১০০ পরিবারের ৭০০; বাঁশখালীর আটটি ইউনিয়নের এক হাজার ৭৫০টি পরিবারের আট হাজার ৭৫০; রাউজানের ১৩টি ইউনিয়নের ৩২০টি পরিবারের এক হাজার ৬০০ জন এবং লোহাগাড়ায় এক ইউনিয়নের ৩০ পরিবারের ১৫০ জন বন্যায় পানিবন্দি হয়েছেন।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় মীরসরাই ও ফটিকছড়ি উপজেলার ৫৯০ কিলোমিটার রাস্তা ও ১২৫টি কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফটিকছড়ি উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৬৫টি নলকূপ ও এক হাজার ৫৩৭টি ল্যাট্রিন।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক সাদি উর রহিম জাদিদ জানান, ‘জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৯৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ৯ হাজার ৬৭ জন। জেলার বন্যাকবলিত এলাকায় চিকিৎসা দিতে গঠন করা হয়েছে ১০৭টি মেডিকেল টিম।’
তিনি আরও জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছে মজুদ রয়েছে ১ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন চাল ও ৩৫ লাখ টাকা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর জন্য মজুদ রাখা আছে ৯০৫ মেট্রিক টন চাল ও ২৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৩৯৫ মেট্রিক টন চাল ও নয় লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। অবশিষ্ট ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি শুকনা খাবারও দেওয়া হচ্ছে।