আগামী ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে হতে যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। যে নির্বাচনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও। প্রতি চার বছর পর পর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন ঘিরে আগ্রহ থাকে সারা বিশ্বের উৎসুক মানুষের। কারণ শুধু মার্কিনিদেরই নয় বরং সারা বিশ্বেরই অর্থনীতি, রাজনীতি ও ভূরাজনীতিতে প্রভাব ফেলে এই নির্বাচনের ফলাফল।
যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অর্থনীতি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই মুহূর্তে মার্কিন অর্থনীতি বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে। কাগজ কলমে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে বেশ শক্তিশালী ভাবেই। বেকারত্বের হারও নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই, এমনকি বর্তমানে মূল্যস্ফীতিও কাগজ-কলমে গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
মার্কিন অর্থনীতির আর্থিক খাতের বিশ্বের খ্যাতনামা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মুডিস অ্যানালিটিকসের প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্ক জানদি বলেন, অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমার ৩৫ বছরের ক্যারিয়ারে আমি কখনই কোনো অর্থনীতিকে এত ভালোভাবে চলতে দেখিনি। আমি বর্তমানে মার্কিন অর্থনীতিকে এ প্লাস দেব।
তবে অদ্ভুত হলেও সত্য যে মার্কিন অর্থনীতির ব্যাপারে অর্থনীতিবিদদের এই মনোভাবের সঙ্গে একমত নন অধিকাংশ মার্কিনীই। সিবিএস নিউজের জরিপে দেখা গেছে, প্রতি ১০ জন মার্কিনির মধ্যে ছয়জনই বর্তমানে তাদের দেশের অর্থনীতিকে ‘খুবই খারাপ’ কিংবা ’খারাপ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ’খুব ভালো’ কিংবা ’ভালো’ বলছেন প্রতি ১০ জনে মাত্র একজন মার্কিনি।
এছাড়া চার বছর আগে থেকে বর্তমানে নিজেদের এবং পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থাকে শোচনীয় বলছেন শতকরা ৫২ শতাংশ মার্কিনি। আর অর্থনীতির ক্ষেত্রে মার্কিনিদের এই হতাশার প্রতিফলন পড়তে যাচ্ছে সামনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যালট পেপারে, এমনটাই জানাচ্ছে দেশটির সংবাদমাধ্যম ও বিশ্লেষকরা।
সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে দেশটির অর্থনীতির অবস্থা আপাতভাবে স্থিতিশীল মনে করা হলেও মূলত মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়ছে মার্কিন ভোক্তাদের ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের গ্যালাপের এক জনমত জরিপে দেখা গেছে অর্ধেকেরও বেশি আমেরিকান জানিয়েছেন চার বছর আগের থেকে বর্তমানে তারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত।
সিবিএস নিউজের জনমত জরিপে দেখা গেছে, মার্কিন অর্থনীতির অবস্থা খুব ভালো অবস্থায় রয়েছে, এমনটা বলছেন প্রতি ১০ জনের মাত্র একজন মার্কিনি। এই অবস্থায় আর মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে বহুল প্রতীক্ষীত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। যে নির্বাচনে বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস মুখোমুখি হবেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের। এবারের নির্বাচনে সিদ্ধান্ত দেয়ার ব্যাপারে মার্কিন ভোটারদের ওপর দেশটির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম।
এ ব্যাপারে সিবিএসকে মার্কিন অর্থনীতিবিদ ক্যাথি বসজ্যানসিক বলেন, যদিও অর্থনীতির তথ্য উপাত্ত অনুযায়ী এই মুহূর্তে সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে, কিন্তু তা স্বত্ত্বেও ভোক্তাদের চোখে অর্থনীতির বর্তমান ও ভবিষ্যত অনেকটাই নিম্নমুখী। কারণ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও বেকারত্বের হারের মতো বিষয়গুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বর্তমানে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় দৈনন্দিন জীবন যাপনের সংগ্রামে মার্কিনিদের জীবনে তা কোনো সুখবর বয়ে আনছে না।
বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ সব কিছুর খরচ বেড়ে যাওয়ায় খাদ্য, বাড়িভাড়া এবং স্বাস্থ্যখাতে খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মার্কিন পরিবারগুলো।
এছাড়া দেশের অর্থনীতির ওপর মার্কিনিদের এই সন্তুষ্টির পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে বাড়তে থাকা অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অসমতা। বিশেষ করে কম শিক্ষিত এবং খেটে খাওয়া শ্রেণির মার্কিনিরা বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে তাদের প্রতিকূলে বলেই বিবেচনা করছেন।
সিবিএসের জরিপে দেখা গেছে, সমস্ত মার্কিনির ব্যাচেলর ডিগ্রি রয়েছে তাদের মধ্যে অর্থনীতি নিয়ে অসন্তোষ তুলনামূলক কম। পক্ষান্তরে যাদের কলেজ ডিগ্রি কিংবা ব্যাচেলর ডিগ্রি নেই, তাদের মধ্যেই মূলত অর্থনীতি নিয়ে অসন্তোষ তুলনামূলক বেশি। অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে উচ্চশিক্ষিত ও কম শিক্ষিত মার্কিন কর্মজীবীদের মধ্যে বেতনভাতা নিয়ে যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, সে বিষয়টিই প্রকাশ পাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সিবিএসের জরিপে দেখা গেছে, শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে যাদের কলেজ ডিগ্রি রয়েছে তাদের ৪৭ শতাংশ অর্থনীতিকে ভালো বলে অভিহিত করেছেন, অপরদিকে যাদের কলেজ ডিগ্রি নেই তাদের মধ্যে অর্থনীতির প্রতি সন্তোষজনক থাকার হার মাত্র ২৯ শতাংশ।
গত কয়েক দশক ধরেই কলেজ ডিগ্রিহীন কর্মজীবীদের তুলনায় কলেজ ডিগ্রিধারীদের আয় এবং সম্পদের পার্থক্য ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে যুক্তরাষ্ট্রে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চের জরিপ অনুযায়ী, বিশেষ করে ব্যাচেলর ডিগ্রিহীন যুবা পুরুষরাই এই বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। কোভিড মহামারি এবং পরবর্তীতে ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বেড়ে যাওয়া মূল্যস্ফীতির কারণে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছে মূলত এই শ্রেণিকেই।
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ মার্ক জান্দি সিবিএসকে বলেন, মহামারি ও যুদ্ধের কারণে গ্রোসারি, বাড়িভাড়া, গাড়ির তেলের খরচ অনেকখানি বেড়ে গেছে। আর নিম্নমধ্যবিত্ত মার্কিনিদের যারা মূলত কম শিক্ষিত তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়ের অনেকখানি জুড়েই থাকে এসব খরচ।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিবারের গ্রোসারি খরচ মহামারি পূর্ব সময়ের থেকেও ২০ শতাংশ বেশি। বর্তমানে দেশটিতে চিনি থেকে শুরু করে নুডলস, এ ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দামও চার বছর আগের তুলনায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেশি। এ পরিস্থিতিতে নিম্নমধ্যবিত্ত ও কর্মজীবী ভোটাররা স্বাভাবিকভাবেই অসন্তুষ্ট দেশটির বর্তমান ডেমোক্র্যাট সরকারের প্রতি। যার প্রভাব পড়তে পারে ৫ নভেম্বরের ভোটে।
অর্থনীতির এই ইস্যুই যে ভোটারদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়টি দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন ও বিভিন্ন জনমত জরিপেও উঠে আসছে। নিউইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, মার্কিন ভোটারদের কাছে এই মুহূর্তে ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি।
পাশাপাশি পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপে দেখা গেছে, ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের সমর্থকদের মধ্যে ৬৮ শতাংশ এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থকদের ৯৩ শতাংশই বলছেন, তাদের কাছে এই মুহূর্তে ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে অর্থনীতিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।