১৯৪৭ সাল। এক বন্ধুর মাধ্যমে ‘মায়াডোর’ নামে একটি হিন্দি সিনেমায় কাজের সুযোগ পান নবীন এক অভিনেতা। পাঁচ দিনের কাজ, দৈনিক পারিশ্রমিক ৫ সিকি। সব ঠিকঠাক ছিল, পারিশ্রমিক কম, ছবিও হলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মুক্তি পায়নি ‘মায়াডোর’। এটিই ছিল নায়ক উত্তম কুমারের প্রথম ছবি যা মুক্তির আলো দেখতে পায়নি। কিন্তু দৈনিক ৫ সিকির এই নায়ক একদিন মহানায়ক খেতাবে সম্মানিত হয়েছেন!
মহানায়ক উত্তম কুমারের আজ ৯৯তম জন্মদিন। তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘দৃষ্টিদান’ মুক্তি পায় ১৯৪৮ সালে। পরের বছর পরিচালক নীতীন বসুর একটি সিনেমায় ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন উত্তম। সেখানে অবশ্য পারিশ্রমিক কিছু বেড়েছিল। শুরুতে ২৭ টাকা দেওয়ার কথা বললেও পরে তাকে দেওয়া হয়েছিল ১৩ টাকা। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। দর্শক সিনেমাটি গ্রহণ করেননি। পরের বছর ‘কামনা’ সিনেমায় প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন উত্তম বাবু। এ ছবিও ফ্লপ। এরপর ‘মর্যাদা’, ‘ওরে যাত্রী’, ‘নষ্টনীড়’ও ব্যর্থ হয়। ধারাবাহিক এই ব্যর্থতা উত্তম কুমারের ক্যারিয়ারকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। সিনেমা করলে যে না খেয়ে থাকতে হবে, সেটা বুঝতে তারও আর বাকি রইল না। চলচ্চিত্র অঙ্গনের মানুষেরা তাকে ভীষণ অপমান শুরু করলেন। শুটিংসেটে ঢুকতেই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শিকার হতেন। পরের ‘সহযাত্রী’ ও ‘সঞ্জীবনী’ও তার ভাগ্য ফেরাতে পারেননি। এভাবে পরপর ৭টি সিনেমা ব্যর্থ হওয়ার পর হয়তো ভাগ্যবিধাতা তাকে ধৈর্য্যের পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেন।
বেশিরভাগ প্রযোজক ও নির্মাতা উত্তম কুমারকে সিনেমায় নিতে চাইতেন না। এমনকি তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলেন। হতাশ হয়ে সিনেমা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন উত্তম কুমার। এ সময় পাশে দাঁড়ান স্ত্রী গৌরী দেবী। ১৯৫২ সালে উত্তম কুমারের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। এমপি প্রোডাকশন নামের এক কোম্পানি তার সঙ্গে তিন বছরের চুক্তি করে। নির্মল দের পরিচালনায় উত্তম অভিনয় করেন ‘বসু পরিবার’ সিনেমায়। এই সিনেমা তার অতীত ব্যর্থতা ঢেকে ফেলে। এরপর সেই বিখ্যাত ও আলোচিত সিনেমা ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ওই একই নির্মাতা ও নায়ক! সুপারহিট হয় ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। এতে তার নায়িকা ছিলেন সুচিত্রা সেন। সেই থেকে শুরু উত্তম-সুচিত্রা জুটির ইতিহাস।
উত্তমের জীবনের গল্প সিনেমার চেয়েও সিনেমাটিক। পারিবারিক জীবন সিনেমার দরিদ্র নায়কের মতোই। কলকাতার এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম তার। বাবা ছিলেন কলকাতার মেট্রো সিনেমা হলের একজন সাধারণ কর্মচারী। কলেজজীবন শেষ করতে পারেননি তিনি। শেষবর্ষে লেখাপড়া বাদ দিতে হয়েছিল। পরিবারের হাল ধরতে কলকাতা বন্দরে মাসিক ২৭৫ টাকা বেতনে কেরানির চাকরি নেন উত্তম কুমার। সেসব আজ সবারই জানা। ওরকম অভাবী পরিবারের ছেলের সিনেমা করতে যাওয়া ছিল বিলাসিতা। প্রবল ইচ্ছেশক্তি তাকে সেদিন টেনে নিয়ে গিয়েছিল তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। গরীবের ছেলে অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায় হয়ে ওঠেন মহানায়ক উত্তম কুমার। সেই থেকে আজও নানা মিথ তৈরি হয় তাকে নিয়ে। বলা হয়ে থাকে, তার জনপ্রিয়তা আজ অবধি স্পর্শ করতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গসহ বাংলাভাষী কোনো অভিনেতা।
১৯৪৮ সালের ১ জুন প্রেমিকা গৌরী দেবীকে বিয়ে করেন উত্তম। তাদের ছেলের নাম গৌতম চট্টোপাধ্যায়। টালিউড অভিনেতা গৌরব চট্টোপাধ্যায় উত্তম কুমারের নাতি। ১৯৬৩ সালে উত্তম কুমার স্ত্রীকে ছেড়ে গিয়ে ওঠেন অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবীর বাড়িতে। সেই থেকে আমৃত্যু তার সঙ্গেই ছিলেন এই অভিনেতা।
সম্প্রতি ভারতীয় একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে উত্তম কুমারকে নিয়ে সিনেমা ‘অতি উত্তম’, নির্মাণ করেছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়। সেখানে উত্তম কুমারের চরিত্রে দেখা গেছে তাকেই। কৃষ্ণেন্দু ও সোহিনীকে নিয়ে এই সিনেমার গল্প। তাদের প্রেম ঘিরে আছেন উত্তম কুমার। সেখানে কৃষ্ণেন্দু চরিত্রে অভিনয় করেছেন অনিন্দ্য সেনগুপ্ত ও সোহিনী চরিত্রে রোশনি ভট্টাচার্য। উত্তম কুমারের নাতির চরিত্রে আছেন গৌরব চট্টোপাধ্যায়।