কয়েক দিন আগেও ছিল ফসলের সবুজ খেত। ভালো ফলন হবে, এমন আশায় দিন গুনছিলেন কৃষক; কিন্তু বন্যার পানিতে সব ফসল নষ্ট হয়েছে। পানি নেমে যাওয়ার পর দেখা দিয়েছে নতুন বিপদ। মাঠের পর মাঠ ঢেকে গেছে বালুর স্তূপে। নিচু জমি উঁচু হয়ে গেছে। বালুর স্তূপ না সরালে জমিতে চাষাবাদ করা সম্ভব নয়। দুশ্চিন্তায় ফেনীর কৃষকদের এখন মাথায় হাত। জমি চাষযোগ্য করে তুলতে তাঁরা এখন সরকারি সাহায্য চান।
পরশুরামের দক্ষিণ কাউতলী গ্রামের কৃষক আবু তালেব মজুমদার। ৩০ শতক জমিতে তাঁর আখখেত ছিল। আখ মাড়াইয়ের পর গুড় তৈরি করে সংসার চলত তাঁর। তিনি বলেন, ‘পাঁচ-সাত ফুট উঁচু বালুর স্তূপ জমে গেছে জমিতে। শুধু আখের মাথাগুলা দেখা যাচ্ছে। ধারকর্জ করে ৯ কানি জমিতে রোপা আমন লাগিয়েছিলাম। সে জমিতেও বালু–কাদা জমে আছে। নতুন করে আমনের চারা এনে রোপণ করতে হলে প্রতি কানিতে (২০ শতক) ২০ হাজার টাকা খরচ করতে হবে। ঘরে খাবার নেই। চাষাবাদ করতে না পারলে, খাব কী?’
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ফেনী জেলার পরশুরাম ও ফুলগাজী এলাকার প্রায় ২৫০ হেক্টর জমি কয়েক ফুট বালুতে ঢেকে গেছে। কৃষকদের দাবি, দ্রুত সরকারিভাবে যেন জমি থেকে বালুর স্তূপ অপসারণ করা হয়। অথবা যাঁদের জমিতে বালুর স্তূপ জমেছে, তাঁদের যেন বালু বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়।
উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম অলকা গ্রামের কৃষক নুর আহাম্মদ (৬৫) ও মো. আলম (৪২) বলেন, বন্যার পানির সঙ্গে আসা বালু জমে গ্রামের জমিগুলোতে তিন-চার ফুট উঁচু স্তূপ হয়ে গেছে। এগুলো অপসারণ করা না গেলে আগামী ১০-১৫ বছরেও কৃষকেরা এসব জমিতে চাষাবাদ করতে পারবেন না।
গত ২০ আগস্ট ফেনীর পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন নিজ কালিকাপুর গ্রাম থেকে উজানের পানি ফেনী জেলার অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে থাকে। এতে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর অন্তত ১৫টি স্থানে নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। পাঁচ-ছয় ফুট উঁচু বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় একের পর এক গ্রাম। বন্যায় উপজেলার ১০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানায় জেলা প্রশাসন। বন্যায় ফেনীতে ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
গত রোববার ফেনীর পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, বন্যার পানি নেমে গেলেও কৃষিজমিতে বালুর স্তূপ রয়ে গেছে। পরশুরাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, উপজেলার ১১টি গ্রামের প্রায় ২২৫ হেক্টর জমি চাষের অযোগ্য হয়ে গেছে। নিজ কালিকাপুর, পূর্ব অলকা, পশ্চিম অলকা, নোয়াপুর, ডুবলাচাঁদ, সাতকুচিয়া, দক্ষিণ কাউতলী, উত্তর কাউতলী, চম্পক নগর, কাশীনগর ও শালধর গ্রামের বাইরেও নদীর আশপাশে কিছু কিছু জমিতে বালুর স্তূপ জমাট হয়ে থাকতে দেখা গেছে।
পরশুরাম উপজেলার সীমান্তবর্তী মির্জানগর ইউনিয়নে দেখা যায়, আবাদি জমিতে চার থেকে ছয় ফুট উঁচু বালুর স্তূপ। এসব জমিতে স্থানীয় কৃষকেরা ধান, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করতেন। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, নিজ কালিকাপুর সীমান্তের অপর পাশে ভারতের বল্লামুখা খালের বাঁধ কেটে দেওয়ায় মুহুরী নদীর পানি নিজ কালিকাপুর গ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
পাঁচ-সাত ফুট উঁচু বালুর স্তূপ জমে গেছে জমিতে। শুধু আখের মাথাগুলা দেখা যাচ্ছে। ধারকর্জ করে ৯ কানি জমিতে রোপা আমন লাগিয়েছিলাম। সে জমিতেও বালু–কাদা জমে আছে
আবু তালেব মজুমদার, কৃষক, দক্ষিণ কাউতলী, পরশুরাম
পরশুরাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. সিফাত হাসান জানান, উপজেলায় শুধু পশ্চিম অলকা গ্রামেই ৯০ হেক্টর ফসলি জমিতে বালু জমে চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে গেছে। এ ছাড়া কালিকাপুর গ্রামে ৪০ হেক্টর, পূর্ব অলকা গ্রামে ২০ হেক্টর, দক্ষিণ কাউতলী, উত্তর কাউতলী ও চম্পকনগর গ্রামের প্রতিটিতে ১০ হেক্টর করে, ডুবলার চাঁদ গ্রামে ৬ হেক্টর, নোয়াপুর ও কাশীনগর গ্রামে ৫ হেক্টর করে, সাতকুচিয়া ও শালধর গ্রামে ২ হেক্টর করে জমির ওপর বালু জমে গেছে। উপজেলায় মুহুরী ও সিলোনিয়া নদীর পাশেই আরও কিছু গ্রামের জমিতে বালু জমে চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে গেছে বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন।
নিজ কালিকাপুরের কৃষক আবু ইউসুফ জানান, বল্লামুখা বাঁধ কেটে দেওয়ার পর প্রায় সাত-আট ফুট উচ্চতার বিশাল স্রোত তাঁর জমির ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। এই বালুর স্তূপের মধ্যে ধান চাষ করা সম্ভব নয়। জমি উঁচু হয়ে যাওয়ায় শীত মৌসুমে পানিও পাওয়া যাবে না। এরই মধ্যে গবাদিপশুর খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।
বন্যার পানির সঙ্গে ফুলগাজী উপজেলায়ও কিছু কিছু জমিতে বালু জমেছে। পানির স্রোতের কারণে অনেক জমি গভীর হয়েছে, আবার অনেক জমি বালু জমে উঁচু হয়ে গেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক একরাম উদ্দিন বলেন, পরশুরামের যেসব স্থান দিয়ে বন্যার পানির সঙ্গে বালু প্রবেশ করেছে, সেখানে ক্ষতি বেশি হয়েছে। এসব জমি থেকে বালু অপসারণ খুবই কষ্টসাধ্য। কৃষি বিভাগ থেকে এসব জমি ও কৃষকের জরিপ করা হয়েছে। কী ধরনের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা যায়, তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হয়েছে।