এ বছরের দ্বিতীয় জনপ্রিয় কোনো রাজনৈতিক নেতাকে হত্যার চেষ্টা ছিল সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর গুলিবর্ষণ। মাত্র দুই মাস আগে স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকোকে খুব কাছ থেকে চারটি গুলি করা হয়েছিল। তিনি গুরুতর আহত হয়েছিলেন। এ দুটি ঘটনা বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক সহিংসতার পুনরুত্থানের আভাস দিচ্ছে।
যদিও ট্রাম্প ও ফিকোকে হত্যার চেষ্টা অনেক উদারপন্থীর বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা দেওয়া কিছুটা কমিয়েছে, তবে তাঁদের এ ধরনের প্রতিক্রিয়াগুলোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পড়ে যাচ্ছে।
সেটি হলো, বর্তমানে যে রাজনৈতিক সহিংসতার উত্থান ঘটছে, তার মূল চালিকা শক্তি কিন্তু কর্তৃত্ববাদীদের সমালোচনা নয়। এর জন্য মূলত দায়ী হলো জনতুষ্টিবাদী নেতাদের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগকে সময়োপযোগীভাবে মোকাবিলা করতে গণতন্ত্রের ব্যর্থতা।
ট্রাম্পের মতো ফিকোও প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে রাজনৈতিক মাঠে প্রত্যাবর্তন করেছেন। পাঁচ বছর আগে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন তাঁর দেশে এক অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও তাঁর বান্ধবী নৃশংসভাবে খুন হন। সেই ঘটনায় ফিকোর ঘনিষ্ঠ লোকেরা জড়িত ছিলেন। ফলে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এরপর তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হন। এরপরই তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়।
দুঃখজনকভাবে স্লোভাকিয়ার গণতন্ত্রপন্থী দলগুলো ফিকোকে তাঁর কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি বাধ্য করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফিকোকে বিচার থেকে দায়মুক্তি দেওয়ার বিধি তুলে নেওয়ার বিরুদ্ধে ২০২২ সালে স্লোভাকিয়ার পার্লামেন্টে যে ভোট হয়েছিল, তাতে বেশির ভাগ পার্লামেন্ট সদস্য দায়মুক্তি তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেন। ফলে তিনি দায়মুক্তি পেয়ে যান। তাঁর বিরুদ্ধে আনা সংঘটিত অপরাধের অভিযোগ থেকে তিনি রেহাই পান এবং তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন। এর এক বছর পর ফিকো ক্ষমতায় ফিরে আসেন এবং তাঁর কর্তৃত্ববাদী এজেন্ডা নিয়ে আবার এগোতে শুরু করেন।
স্লোভাকিয়ায় ফিকোর দায়মুক্তির রক্ষাকবচ ছিনিয়ে নিতে ব্যর্থতার কারণে উদারপন্থীরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রত্যাখ্যানের কবলে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। অনেক মার্কিন উদারপন্থী ট্রাম্পের বিরুদ্ধে করা ফৌজদারি মামলার ধীরগতির জন্য বিচারব্যবস্থার আলসেমিকে দায়ী করেন। এই বিলম্বের কারণ হিসেবে কাজ করা অনেক ত্রুটিকে উপেক্ষা করা হয়েছে বলেও মনে করা হয়।
এই ত্রুটিগুলোর মধ্যে প্রধান ত্রুটি হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে মেরিক গারল্যান্ডকে নিয়োগ দেওয়া। ২০২২ সালের গোড়ার দিকে ট্রাম্পের অসংখ্য অপরাধের বিচার করতে গারল্যান্ডের অনীহা নিয়ে খোদ বাইডেন হতাশা প্রকাশ করেছিলেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রেওয়াজের প্রতি সম্মান রেখে বাইডেন গারল্যান্ডকে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আগ্রাসী ভূমিকা রাখতে কোনো তাড়া দেননি।
রাজনৈতিক সহিংসতার এই সাম্প্রতিক পুনরুত্থান আমাদের এই রীতি–রেওয়াজগুলোকে পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করবে। হত্যার চেষ্টাকারীদের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল, তা যদিও আমরা কোনো দিনই পুরোপুরি বুঝতে পারব না; তবে এটুকু আমরা ধারণা করতে পারি, গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত একজন প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যখন বছরের পর বছর ধরে ন্যায়বিচার এড়িয়ে থাকতে সুযোগ পান, তখন সেটি অনিবার্যভাবেই সামাজিক উত্তেজনা তৈরি করে।
ট্রাম্পের জীবনের ওপর হামলা হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ফক্স নিউজ ও অন্যান্য রক্ষণশীল মিডিয়া আউটলেট বারবার ট্রাম্প সম্পর্কে বাইডেনের মন্তব্যকে প্রচার করছিল। বাইডেন ট্রাম্পকে ‘আমাদের গণতন্ত্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। বাইডেনের এ–জাতীয় মন্তব্যগুলোকে এসব সংবাদমাধ্যম উসকানিমূলক রাজনৈতিক বক্তব্যের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছে।
বাইডেনের বিরুদ্ধে ওঠা এই সমালোচনা আংশিকভাবে সঠিক। কারণ, বিদ্রোহকে উসকে দেওয়ার বা অন্যান্য অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হওয়ার বিষয়। কারও বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হওয়ার আগেই তা নির্বাচনী প্রচারের রসদ হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র প্রমাণ করেছে, তাদের সাবেক নেতারা তাদের করা অপরাধের জন্য অভিযুক্ত হতে পারেন। ফ্রান্সের দুই সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক ও নিকোলা সারকোজিকে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ও দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল।
ব্রাজিলে সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোকে তাঁর উত্তরসূরি লুলা দা সিলভাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টার কারণে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। তার এক বছর পর বলসোনারো অর্থ পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন এবং একাধিক অপরাধমূলক তদন্তের মুখোমুখি হয়েছেন।
কিন্তু বৃহৎ গণতন্ত্রে যখন সাবেক নেতারা নানা অপরাধের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পেয়ে যান, তখন সমাজে ক্ষোভ তৈরি হয়। ট্রাম্প ও ফিকোকে হত্যার চেষ্টা সেই ক্ষোভের প্রকাশ হতে পারে।