বাংলাদেশ থেকে সরকারি সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মালয়েশিয়ায় পাঠাতে না পারা প্রায় ১৭ হাজার কর্মী এখন দিশেহারা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দফায় দফায় সিদ্ধান্ত বদলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বেশিরভাগ কর্মীই টাকা ফেরত পায়নি আর যারা পেয়েছেন, তাদের নামে মাত্র টাকা দিয়ে বিদায় করা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সাড়ে ৫ লাখ থেকে শেষ দিকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন তবে নানা অযুহাতে নির্ধারিত ৩১ মে ২০২৪ এর মধ্যে মালয়েশিয়ার ফ্লাইটে উঠার ভাগ্য হয়নি তাদের
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে চলতি বছরের ৩১ মে ছিল বিদেশি কর্মী যাওয়ার পূর্ব নির্ধারিত শেষ দিন জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো- বিএনইটিব ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড ইস্যু হয়েছিল কিন্তু বিমানবন্দরে গিয়েও কর্মীরা ফ্লাইটে উঠতে পারেননি, এমন সংখ্যা ১৬ হাজার ৯৭০ জন এই কর্মীরা যেই সাড়ে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন, সেই টাকার মধ্যে প্রায় দেড় লাখ নিয়েছে কথিত ১০০ রিক্রটিং এজেন্সি সিন্ডিকেট আর বাকি প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা রয়েছে সহযোগী বা অথরাইজড রিক্রুটিং এজেন্সির দায়িত্বে বিএমইটি ও রিক্রুটিং এজেন্সি সূত্রে পাওয়া তালিকা অনুযায়ি এই সংখ্যা সাড়ে ৭শ’ ৩৫টি
অন্যদিকে কর্মীদের টাকা ফেরত দিতে এখন পর্যন্ত অন্তত তিনবার পদ্ধতি পরিবর্তন করেছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে এই সময়ে বাংলাদেশে ৩টি সরকার এসেছে যদিও ৩টি সরকারেই এই মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে কাজ করছেন মো. রুহুল আমিন এক সচিবই বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করায় দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন এতে করে কর্মীরা টাকা বুঝে পাচ্ছেন না কেউ কেউ পেলেও ৬ লাখের জায়গায় কর্মীকে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ দিয়েই, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রাপ্তিস্বীকারপত্রে সই নেয়ার অভিযোগ আছে এমন বাস্তবতায় ক্ষতিগ্রস্ত করর্মীদের এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকার দশা
কর্মীদের দেয়া ৬ লাখ টাকা কোথায় গেলো?:
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে প্রকাশ্যেই আছে রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের ১০০ জনের সিন্ডিকেট শুরুতে ২৫ টি রিক্রুটিং এজেন্সি, এরপর দুই দফায় আরো ৭৫টি ও সরকারি প্রতিষ্ঠান বোয়েসেল যুক্ত হয় বেসরকারি এই ১০০ রিক্রুটিং এজেন্সি মূলত ভিসা প্রসেস করা বা বাজারের আড়তের ভূমিকা পালন করেছে এদের বলা হয় ‘অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সি’ বা মেইন বিআরএ
এছাড়া মালয়েশিয়া থেকে মূল ভিসা বা চাহিদাপত্র সংগ্রহ করা অথবা ভিসা কিনে আনা এবং দেশে কর্মী সংগ্রহ করেছে এমন রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৭শ’ এই সাড়ে ৭শ’ রিক্রটিং এজেন্সি কর্মী সংগ্রহ করেছে সরাসরি অথবা মাঠ পর্যায়ে তাদের প্রতিনিধির (সাব এজেন্ট বা মধ্যস্বত্ত্বভোগী) মাধ্যমে এই রিক্রুটিং এজেন্সিকে বলা হয় ‘অথরাইজড রিক্রুটিং এজেন্সি’ বা সহযোগি এজেন্সি অথরাইজড রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে হলে সিন্ডিকেটের ১০০ এজেন্সির মাধ্যমেই বিএমইটি’র ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স নিতে হয়েছে বা ভিসা প্রসেস করে কর্মী পাঠাতে হয়েছে এর জন্য সিন্ডিকেটের সদস্যকে ( ১০০ রিক্রুটিং এজেন্সি) দিতে হয়েছে প্রায় দেড় লাখ (১,৫০,০০) টাকা
তাহলে কর্মীরা যে সাড়ে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন তার বাকি টাকা কোথায়? বাকি প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকার দায় অথরাইজড রিক্রুটিং এজেন্সি বা সিন্ডিকেটের বাইরের সেই পওায় সাড়ে ৭শ’ রিক্রুটিং এজেন্সি যারা মালয়েশিয়া থেকে চাহিদাপত্র বা মূল ভিসা এনেছেন এবং দেশে কর্মী সংগ্রহ করেছেন মূলত কর্মীরা সরাসরি বা মাঠ পর্যায়ের প্রতিনিধির মাধ্যমেই অথরাইজড রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে টাকা ও পাসপোর্ট দিয়েছে আর এই রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর ওপরই বাকি সাড়ে ৪ লাখ টাকার দায় বর্তায়
মোটকথা, কর্মীরা প্রায় ৬ লাখ টাকা দিয়েছে অথরাইজড রিক্রুটিংএজেন্সির কাছে, সরাসরি অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে অথরাইজ রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী পাঠানোর প্রসেস করাতে সিন্ডিকেটকে দিয়েছে দেড় লাখ টাকা আইনগতভাবে, দুই রিক্রুটিং এজেন্সিকেই কর্মীদের সম্পূর্ণ টাকা ফেরত দিতে হবে কারণ, সিন্ডিকেটের সদস্যদের লাইসেন্স ব্যবহৃত হয়েছে, বিএমইটির ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স করার ক্ষেত্রে আর অথরাইজড রিক্রুটিং এজেন্সি বা সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো অঙ্গীকারনামা দিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী পাঠিয়েছে মালয়েশিয়ায়
দফায় দফায় মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন:
৪ জুলাই ২০২৪ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী জানান, বায়রার সঙ্গে বৈঠকে তারা টাকা ফেরত দিতে সম্মত হয়েছে। কর্মীরা যে যত টাকা দিয়েছে, ১৮ জুলাইয়ের মধ্যে সেই টাকা ফেরত দিতে হবে কর্মীরা বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স অনুযায়ী ১০০ রিক্রুটিং এজেন্সির সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে গিয়ে টাকা নিতে পারবে
২৮ আগস্ট ২০২৪ মন্ত্রণালয় থেকে রিক্রুটিং এজেন্সিকে নতুন নিয়ম উল্লেখ করে আরেকটি চিঠি দেয়া হয় সেই চিঠর মূল বিষয় হচ্ছে, “আগামী ০৩-০৯-২০১৪ তারিখের মধ্যে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণকারী ১০১ টি রিক্রুটিং এজেন্সি সরাসরি কর্মী বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সিসমূহকে দায়-দেনা পরিশোধ করবে এবং সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সিসমূহ আগামী ১০-০৯-২০২৪ তারিখের মধ্যে সরাসরি কর্মীদের অর্থ ফেরত প্রদান করবে মর্মে নির্দেশনা প্রদান করেন”
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ আবারো নতুন পদ্ধতি আবিস্কার করে মন্ত্রণালয় এবার রিক্রুটিং এজেন্সিকে দেয়া চিঠিতে বলা হয়, “মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণকারী ১০০ টি রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের অনুকূলে বহির্গমন ছাড়পত্র প্রদানকৃত যে সকল কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি, তাদের প্রত্যের দায়-দেনা পরিশোধ (নিজে কিংবা প্রযোজ্যা ক্ষেত্রে সহযোগি এজেন্সির মাধ্যমে)। সংক্রান্ত প্রমাণপত্রসহ বিস্তারিত তথ্যাদি আগামী ১০-১০ ২০২৪ তারিখের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে অবহিত করবেন”
কর্মীদের সম্পূর্ন টাকা ফেরত দিতে মন্ত্রণালয়ের করণীয় হতে পারে:
কর্মীদের টাকা ফেরতের সদিচ্ছা থাকলে মন্ত্রলায়ের লাইসেন্স নেয়া দুটি রিক্রুটিং এজেন্সিকেই দায়িত্ব দিতে হবে কারণ, অথরাইজড রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পাসপোর্ট -ভিসা ও ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স নেয়ার সময় একটি অঙ্গিকারনামা জমা দিয়েছে সেই অঙ্গিকারনামায় নিয়োগদাতা কোম্পানীতে কর্মীর সঠিক কাজ ও বেতনের নিশ্চয়তাসহ যাবতীয় দায়িত্ব নেয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে তাই পাঠাতে না পারা কর্মীদের তালিকা থেকে কোন রিক্রুটিং এজেন্সি ভিসা প্রসেস করেছে, তা আলাদা করে সিন্ডিকেটর ১০০ রিক্রুটিং এজেন্সির সংশ্লিষ্ট এজেন্সিকে দিবে মন্ত্রণালয় একই সাথে অঙ্গিকারনামা অনুযায়ী ঐ কর্মী কোন অথরাইজড বা সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সি সংগ্রহ করেছে, সিন্ডিকেট সদস্যের কাছ থেকে সেই তথ্য নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকেই নোটিশ দিতে হবে কর্মী পাঠানো বা টাকা নেয়ার জন্য দায়বদ্ধ এই দুই রিক্রুটিং এজেন্সিকে সময় নির্ধারণ করে দিয়ে কর্মীদের সম্পূর্ণ টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করতে হবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে
২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর মালয়েশিয়া সরকারের সাথে কর্মী পাঠানোর সমঝোতা স্মারক সই হয়। এর পর ২০২২ সালের ৮ আগস্ট থেকে কর্মী পাঠানো শুরু হয় দেশটিতে। ৩১ মে ২০২৪ পর্যন্ত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যাুরো- বিএমইটি থেকে ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ জনকে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স বা ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। শেষ দিন পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় গিয়েছেন ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৬৭২ জন কর্মী বিএমইটি’র তথ্য অনুযায়ী ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স হওয়ার পরও ১৬ হাজার ৯৭০ জন মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি।