যুবকদের চাকরি প্রত্যাশার সংকট: দায়বদ্ধতা ও সম্ভাবনার সন্ধান

‘স্যার, আমি একজন যুবক। বাংলাদেশ থেকে। ইউরোপ আমার স্বপ্ন। আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। মাস্টার্স শেষ করেছি এবং হোটেল ম্যানেজমেন্টে ডিপ্লোমা করেছি। অনেকের কাছে সাহায্য চেয়েছি, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। আমার ৯ বছরের হাউসকিপিংয়ের অভিজ্ঞতা আছে। যদি আপনি আমাকে সাহায্য করেন, আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।’

এভাবে প্রায়ই চিঠি আসে আমার কাছে। দেশের কর্মরত দূতাবাসগুলো দিব্বি বেতন তুলছে, সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধে ভোগ করছে, অথচ যাদের জন্য এতকিছু, তাদের জন্য কিছুই করছে না—এটাই আমাকে কষ্ট দেয়। রাষ্ট্র যেন ব্যস্ত তাদের নিয়েই, যাদের সব আছে, কিন্তু কি হবে অভাগা যুবকের মতো বেকারদের জীবনের? তারা আর কতদিন আহাজারি করবে, জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় জ্বলে পুড়ে মরবে? কেউ কি নেই তাদের ভাগ্যের পরিবর্তনে কিছু করতে চায়? আমি তাদের দরবারে এদের হয়ে আমার এই বার্তা পেশ করছি।

বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে, চাকরি খোঁজার প্রক্রিয়া একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। অনেক যুবক, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তাদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধার অভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন। এটি একটি মানবিক সমস্যা, যা আমাদের সমাজের নৈতিক দায়িত্ব এবং দায়িত্বশীলতার বিষয়।

যুবকদের জন্য চাকরি পাওয়ার সুযোগের অভাব একটি সাধারণ বাস্তবতা। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও, উচ্চ শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা থাকার পরেও, তারা যে চাকরি পাচ্ছেন না, তা তাদের জীবনকে কঠিন করে তুলছে। আমাদের দেশে প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক সময় পেশাগত দক্ষতার সাথে সম্পর্কিত নয়, যা যুবকদের বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে বাধ্য করছে। অথবা চাকরি খোঁজার সময় কোনো বিশেষ প্রস্তুতি বা দিকনির্দেশনার অভাবও তাদের হতাশায় অবদান রাখে।

সম্ভাব্য উপায়

১. বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ:
সরকার ও বেসরকারি খাত উভয়কেই প্রয়োজন যুবকদের জন্য অধিকতর বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার। বিশেষ করে, হোটেল ম্যানেজমেন্টের মতো ক্ষেত্রগুলোতে যেখানে দক্ষতার চাহিদা রয়েছে। এছাড়া, প্রশিক্ষণের মান নিশ্চিত করার জন্য অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া উচিত।

২. স্থানীয় উদ্যোক্তা তৈরি:
সরকারের উচিত স্থানীয় উদ্যোক্তা তৈরি করা। যুবকদের মধ্যে আত্মকর্মসংস্থানের জন্য সহায়তা প্রদান করা গেলে, তারা নিজেদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারবে। এক্ষেত্রে, উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারি নীতিমালা ও প্রণোদনা প্রদান করা হতে পারে।

৩. সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্ব:
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির সাথে পার্টনারশিপ গড়ে তুলে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালানো যেতে পারে, যেন যুবকেরা চাকরির সুযোগ পেতে পারেন। এটি যুবকদের দক্ষতার উন্নয়ন এবং চাকরির বাজারে তাদের প্রতিযোগিতামূলক করতে সাহায্য করবে।

৪. নেটওয়ার্কিং এবং সংযোগ স্থাপন:
যুবকদের জন্য নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা প্রয়োজন, যেখানে তারা নিজেদের দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারে এবং চাকরিদাতাদের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। এক্ষেত্রে, চাকরির মেলার আয়োজন এবং কর্মশালা করার মাধ্যমে তাদের যোগাযোগের সুযোগ বাড়ানো উচিত।

৫. মনোবল বৃদ্ধি:
যুবকদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং মনোবল বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি চালানো উচিত। তাদের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতন করা এবং প্রেরণা জোগানো যেতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তাদের সাথে যোগাযোগ এবং সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি করা যেতে পারে।

প্রতিকার

১. সরকারি উদ্যোগ:
সরকারের উদ্যোগের মাধ্যমে চাকরি প্রাপ্তির সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে, যেন যুবকদের জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট কর্মসংস্থান তৈরি হয়। এটি যুবকদের দক্ষতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ পাবে এবং তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারবে।

২. এমএলএ, এমপি এবং স্থানীয় নেতাদের উদ্যোগ:
স্থানীয় নেতাদের উচিত যুবকদের পেশাগত জীবন নিয়ে আরও উদ্যোগী হওয়া, তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং সমর্থন দেওয়া। যুবকদের সমর্থন করার জন্য তাদের পরিকল্পনা ও কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা জরুরি। সামাজিক সমস্যা সমাধানে স্থানীয় সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করা উচিত।

৩. সোশ্যাল মিডিয়া এবং প্রযুক্তির ব্যবহার:
যুবকদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে চাকরির সুযোগ ও তথ্য ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে, যাতে তারা সহজেই যোগাযোগ করতে পারে। প্রযুক্তির ব্যবহারে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও নতুন চাকরির সুযোগ খোঁজার জন্য অনলাইন প্রশিক্ষণ আয়োজন করা যেতে পারে।

কূটনৈতিকদের করণীয়

কূটনৈতিকদের এই পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের দায়িত্ব শুধু দেশের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করা নয়, বরং বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিকদের কল্যাণ ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাও।

১. নিয়মিত খোঁজখবর নেওয়া:
কূটনৈতিকদের উচিত নিয়মিতভাবে সেসব দেশে খোঁজখবর নেওয়া, যেখানে তারা কর্মরত। স্থানীয় শ্রমবাজার, চাকরির সুযোগ, এবং বাংলাদেশি নাগরিকদের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাশোনা করা অপরিহার্য।

২. দক্ষ কর্মীর প্রয়োজনীয়তা:
প্রতিটি দেশে কোন ধরনের দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন আছে, তা সঠিকভাবে বুঝতে হবে। যেমন, হোটেল ম্যানেজমেন্ট, হাউসকিপিং, এবং অন্যান্য পেশায় দক্ষ কর্মীর চাহিদা থাকলে, কূটনৈতিকদের উচিত সেই অনুযায়ী কর্মসূচি তৈরি করা।

৩. যদি দক্ষ কর্মী না থাকে:
যদি দেখা যায় যে, সংশ্লিষ্ট দেশে দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে, তবে কূটনীতিকদের উচিত দেশে স্থানীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা। সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করে যুবকদের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু করা যেতে পারে। স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই বিষয়ক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা উচিত।

৪. নিয়মিত রিপোর্টিং:
দূতাবাসগুলোকে নিয়মিতভাবে রিপোর্ট তৈরি করে দেশের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠাতে হবে। এসব রিপোর্টে দেশের যুবকদের চাহিদা, কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং সমস্যাগুলোর ওপর আলোকপাত করতে হবে। এতে করে সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে। এই রিপোর্টগুলোর ভিত্তিতে কর্মসংস্থান নীতি সংশোধনেরও সুযোগ রয়েছে।

৫. স্থানীয় নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা:
কূটনীতিকদের উচিত স্থানীয় ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা, যাতে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক চাকরির মেলায় অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজনের মাধ্যমে তারা এই কাজটি করতে পারেন।

৬. জনসচেতনতা বৃদ্ধি:
বাংলাদেশিদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা বিদেশে কাজ করার সুযোগ সম্পর্কে আরও জানে এবং সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে পারে। সেমিনার, ওয়েবিনার ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করা যেতে পারে। এবং যুবকদের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে চাকরির তথ্য ও প্রস্তুতি সম্বন্ধে তথ্য সরবরাহ করা যেতে পারে।

যুবকদের চাকরি প্রত্যাশার এই বাস্তবতা কেবল তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা নয় বরং আমাদের দেশের জন্য একটি গুরুতর মানবিক চ্যালেঞ্জ। কূটনীতিকদের দায়িত্ব হল তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা, যাতে যুবক এবং তার মতো আরও অনেক যুবক তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পেতে পারে। একটি মানবিক সমাজ গড়তে হলে, কূটনীতিকদের কার্যকরী ভূমিকা পালন করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করা যায় এবং সমাজের উন্নয়ন সাধিত হয়।

যুবকদের জন্য চাকরি প্রত্যাশার এই বাস্তবতা সমাজের একটি মানবিক বিষয়। আমাদের সকলকে একত্রে কাজ করতে হবে, যাতে আরও অনেক যুবক তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান পেতে পারে। একটি মানবিক সমাজ গড়তে হলে, আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে এবং সবার জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এটি শুধু যুবকদের জন্য নয়, বরং আমাদের দেশ ও সমাজের উন্নয়নের জন্যও অত্যন্ত জরুরি। যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হলে আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্বশীলতার প্রমাণ দিতে হবে এবং একসাথে কাজ করতে হবে। আমরা যদি সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য উদ্যোগী হই, তবে কেবল তখনই আমরা একটি সমৃদ্ধ ও মানবিক সমাজ গড়তে সক্ষম হব।

এ জন্য রাষ্ট্রের উচিত কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উচিত যুবকদের প্রতি সহযোগিতা বৃদ্ধি করা, এবং সর্বোপরি আমাদের সকলের উচিত মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে যুবকদের পাশে দাঁড়ানো। যুবক এবং তার মতো অসংখ্য যুবকের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমাদের সক্রিয়তায় এবং মানবিকতার প্রকাশে।

তাহলে আসুন, আমরা সবাই মিলে একটি মানবিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করি, যেখানে যুবকেরা তাদের সম্ভাবনা অনুযায়ী উন্নতি করতে পারে এবং সবার জন্য সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়।

  • Rofiq Kazi

    Related Posts

    মাইকে ঘোষণা দিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, আহত ৪০

    হবিগঞ্জ সদর উপজেলার মোহনপুর ও বহুলা গ্রামবাসীর মধ্যে মাইকে ঘোষণা দিয়ে সংঘর্ষে ৪০ জন আহত হয়েছে। সোমবার (১৮ নভেম্বর) রাত সাড়ে ৮টায় জেলা সদরের বাইপাস এলাকায় ইয়ামাহা শো-রুমের সামনে এ…

    Continue reading
    নিউইয়র্কে ছুরিকাঘাতে নিহত ২, আহত ১

    যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে ছুরিকাঘাতে দুজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও একজন।সন্দেহভাজন হামলাকারীকে আটক করেছে পুলিশ।   নিউইয়র্ক পুলিশ বলছে, তিনটি ভিন্ন স্থানে বিনা প্ররোচনায় ছুরি হামলার পর ৫১ বছর বয়সী…

    Continue reading

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    মাইকে ঘোষণা দিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, আহত ৪০

    মাইকে ঘোষণা দিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, আহত ৪০

    নিউইয়র্কে ছুরিকাঘাতে নিহত ২, আহত ১

    নিউইয়র্কে ছুরিকাঘাতে নিহত ২, আহত ১

    টাঙ্গাইলে বাস-পিকআপ সংঘর্ষে নিহত ৪

    টাঙ্গাইলে বাস-পিকআপ সংঘর্ষে নিহত ৪

    পর্তুগালের সঙ্গে ঘাম ঝরানো ড্রয়ে কোয়ার্টারে ক্রোয়েশিয়া

    পর্তুগালের সঙ্গে ঘাম ঝরানো ড্রয়ে কোয়ার্টারে ক্রোয়েশিয়া

    দক্ষিণী সুপারস্টার আল্লু অর্জুন কথা বলছেন বাংলায়!

    দক্ষিণী সুপারস্টার আল্লু অর্জুন কথা বলছেন বাংলায়!

    যুবকদের চাকরি প্রত্যাশার সংকট: দায়বদ্ধতা ও সম্ভাবনার সন্ধান

    যুবকদের চাকরি প্রত্যাশার সংকট: দায়বদ্ধতা ও সম্ভাবনার সন্ধান

    ফের অবরোধে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা, যান চলাচল বন্ধ

    ফের অবরোধে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা, যান চলাচল বন্ধ

    ফের শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হরিনি আমারাসুরিয়া

    ফের শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হরিনি আমারাসুরিয়া

    নারায়ণগঞ্জে মেসে আগুন, ৬ কক্ষ পুড়ে ছাই

    নারায়ণগঞ্জে মেসে আগুন, ৬ কক্ষ পুড়ে ছাই

    আয়ারল্যান্ড সিরিজের দল ঘোষণা করল বিসিবি

    আয়ারল্যান্ড সিরিজের দল ঘোষণা করল বিসিবি