দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ায় স্ব-মহিমায় বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করে চলেছেন প্রবাসীরা। কর্ম, শিষ্টাচার, মেধা ও প্রজ্ঞায় নিজ দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন তারা। কেউ কেউ পাচ্ছেন কাজের স্বীকৃতিও। তাদেরই একজন অধ্যাপক ড. মাঈন উদ্দিন খন্দকার। ড. মাঈন উদ্দিন খন্দকার মালয়েশিয়ার সানওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও বিকিরণ প্রযুক্তির অধ্যাপক।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ার সানওয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘এক্সিলেন্স ইন রিসার্চ-২০২৪’ পদকে ভূষিত হলেন প্রবাসী বাংলাদেশি এ অধ্যাপক। গত ৫ সেপ্টেম্বর এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার হাতে পদকটি তুলে দেন সানওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন গ্রুপের (এসইজি) সি.ই.ও. প্রফেসর দাতো এলিজাবেথ লি।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন, সানওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো ভাইস-চ্যান্সেলর (গবেষণা ও স্থায়িত্ব) অধ্যাপক মাহেন্দ্রিরণ নায়ার, প্রো ভাইস-চ্যান্সেলর (শিক্ষা) প্রফেসর চাই লে চিং ও সানওয়ে বিশ্ববিদ্যালযয়ের প্রভোস্ট, অধ্যাপক আভিমন্যু বীরাকুমারাশিবাম।
তিনি ২০০৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি, ১৯৯৬-৯৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি (প্রথম শ্রেণিতে প্রথম) এবং বিএসসি (প্রথম শ্রেণিতে প্রথম) ডিগ্রি নিয়ে, বর্তমানে বিকিরণ ও পারমাণবিক পদার্থ বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন।
তার কর্মজীবন মালয় বিশ্ববিদ্যালয় (মালয়েশিয়া), আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (অস্ট্রিয়া), আমেরিকান আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়-বাংলাদেশ এবং কোরিয়া পারমাণবিক শক্তি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতো মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে বিস্তৃত।
গবেষণা এবং উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য অধ্যাপক খন্দকার, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির এক্সপ্যাট্রিয়েট ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন।
তিনি ২০১৮ সাল থেকে সানওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও ২০১২ সাল থেকে মর্যাদাপূর্ণ ‘ফিজিক্যাল অ্যান্ড কেমিক্যাল সায়েন্সেস (রিকেন, জাপান)’ এবং ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ রেডিওলজিকাল সায়েন্সেস (জাপান)’ এ ভিজিটিং বিজ্ঞানী হিসেবে গবেষণারত।
এখন পর্যন্ত তিনি সর্বমোট ৬৫৪টি আর্টিকেল স্কোপাস-ইনডেক্সড জার্নালে প্রকাশ করেছেন। এসব আর্টিকেলগুলো ফেলো গবেষকদের প্রকাশনায় সর্বমোট ১৪৪২০ বার উদ্ধৃত হয়েছে। তার বর্তমান এইচ-ইনডেক্স ৫৮ এবং আই-১০ ইনডেক্স ৩৬৫, যা তাকে ‘পারমাণবিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি’ বিভাগে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের মধ্যে শীর্ষ ১ শতাংশে রেখেছে।
এলসভিআর দ্বারা প্রকাশিত মর্যাদাপূর্ণ ‘রেডিয়েশন ফিজিক্স এবং কেমিস্ট্রি’ জার্নাল, ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টার্স’ (নেচার পাবলিশার) জার্নাল, ইত্যাদিসহ বিভিন্ন জার্নালের সম্পাদক হিসাবে তার ভূমিকায় এবং ১৫ জনেরও বেশি পিএইচডি প্রার্থীদের সফল তত্ত্বাবধান অধ্যাপক খন্দকারের একাডেমিক নেতৃত্বের স্পষ্ট প্রমাণ প্রদান করে।
তিনি আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা কর্তৃক প্রণীত গবেষণা প্রজেক্ট ‘থেরানোস্টিক রেডিওনিউক্লাইড উৎপাদন এবং ব্যবহার’ এর প্রধান বৈজ্ঞানিক তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন, যা একাডেমিক পরামর্শদাতা এবং গবেষণা নেতৃত্বের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করে। বিশ্ব সায়েন্টিফিক কমিউনিটিতে অধ্যাপক খন্দকারের তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ, এলসভিআর পাবলিশার পরপর চার বছরের জন্যে তাকে ওয়ান অব দ্যা মোস্ট ভেলুয়েবল রিভিউআর হিসেবে পুরস্কৃত করেছেন।
অধ্যাপক খন্দকারের কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মালয়েশিয়ার সানওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ‘এক্সিলেন্স ইন রিসার্চ-২০২৪’ এবং ‘এক্সিলেন্স ইন রিসার্চ-২০২২ (কমেন্ডেশন)’ পদকে ভূষিত হন। এছাড়াও অধ্যাপক খন্দকার ২০২১, ২০২২ এবং ২০২৩ সালের জন্য এলসেভিয়ার-স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক যৌথভাবে প্রস্তুতকৃত তালিকায় বিশ্বের প্রভাবশালী ২ শতাংশ শীর্ষ গবেষকদের একজন হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন।
শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) এক সাক্ষাতে ড. মাঈন উদ্দিন খন্দকার বলেন, সানওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে মালয়েশিয়ার এক নম্বর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ধরা হয়। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়ার্ল্ড ক্লাস, ফুল ফান্ডেড পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু আছে। যদিও এটি একটি কম্পিটিটিভ প্রক্রিয়া। অনেক বাংলাদেশি স্টুডেন্ট এই স্কিমের মধ্য দিয়ে এখানে পিএইচডি গবেষণারত। আমার তত্ত্বাবধানে বর্তমানে ন্যূনতম তিনজন বাংলাদেশি স্টুডেন্ট এই স্কিমের আওতায় পিএইচডি গবেষণা করছেন।
যেহেতু আমরা কমপক্ষে ১০ জন বাংলাদেশি ফ্যাকাল্টি মেম্বার এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি, সেহেতু আমাদের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের এখানে পিএইচডি প্রোগ্রামে নেওয়া। এটা বাংলাদেশি স্টুডেন্টদের জন্য খুবই ভালো সুযোগ। বিগত প্রায় ২০ বছরের বেশি সময় ধরে একাডেমিক এবং গবেষণা কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে আমি আমার ম্যাক্সিমাম পোটেনশিয়ালে উন্নীত হয়েছি।
মঈন বলেন, একটা সময় ছিল দরিদ্রপীড়িত বাংলাদেশকে বিশ্ব চিনত। এরপর কায়িক পরিশ্রম করা কর্মীদের দেখছে বিশ্ব। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে যে মেধার ও কৃতিত্বের বিস্ফোরণ দেখাচ্ছে বাংলার মেধাবী সন্তানরা, সেসব প্রমাণ এখন ক্রমান্বয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। এ যেন স্বাধীনতা অর্জনের মতোই। যার যা আছে তাই নিয়ে লড়াই করে বিশ্বের বুকে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন বাংলাদেশিরা।
ছাত্র জনতার অনেক ত্যাগের মধ্য দিয়ে এখন সুবর্ণ সুযোগ এসেছে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্ব মানে উন্নীত করার। মূলত, পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে আমি বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি। বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে শিক্ষা এবং গবেষণায় অনগ্রসর এবং দারিদ্র্য পীড়িত দেশ হিসেবে আর দেখতে চাই না।
এই অবস্থার উন্নতিকল্পে প্রশাসন এবং দেশের মানুষ যদি আমার সহযোগিতা কামনা করে, তবে সেটি আমি সানন্দে গ্রহণ করব এবং শুধু দেশকে ভালোবেসে, একটা সেটেলড এবং ঝামেলামুক্ত জীবন ছেড়ে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার প্রত্যয় নিয়ে দেশে ফিরে যাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।