শিরোনামের প্রশ্ন শুনে আপনি অবাক হতে পারেন। যশরাজের এন্তার স্পাই সিনেমার ভিড়ে কোথাকার কোন ‘বার্লিন’কে সেরা বলা হচ্ছে! ‘পাঠান’, ‘টাইগার’ বা ‘কবির’কে নিয়েই বক্স অফিসে ধুন্ধুমার, এই ‘বার্লিন’ আবার কোথা থেকে এল? জানিয়ে রাখা ভালো, ‘বার্লিন’ কিন্তু কোনো চরিত্র নয়, জার্মানির সুপরিচিত রাজধানী শহর বার্লিনের সঙ্গেও এর সম্পর্কে নেই; বার্লিন হলো দিল্লির একটি ক্যাফে। যাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে অতুল সাভারওয়ালের সিনেমা ‘বার্লিন’-এর গল্প। গত ১৩ সেপ্টেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম জি-ফাইভে মুক্তি পেয়েছে ছবিটি। এর পর থেকেই ভাসছে সমালোচকদের প্রশংসায়। কিন্তু এমন কী আছে এই সিনেমায়? কেন এটিকে ভারতের অন্যতম সেরা স্পাই-থ্রিলার বলা হচ্ছে?
দিল্লির একটি ক্যাফে ‘বার্লিন’ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের আঁতুড়ঘর। এই ক্যাফেকে ঘিরেই গল্প। পুরোনো ধাঁচের এই ক্যাফেতে আড্ডা বসত বিভিন্ন দেশের গুপ্তচরদের। ক্যাফের আরেকটি বিশেষত্ব ছিল। যেখানে শুধু মূক-বধির লোকদের কর্মী হিসেবে নিয়োগ করা হতো। কেন? যে ইন্টেলিজেন্স এজেন্টরা সেখানে গোপন বৈঠক সারত, তাদের কার্যকলাপ আড়াল রাখতেই এহেন ফন্দি। মূক-বধির হওয়ার কারণে ষড়যন্ত্রকারীদের টেবিলে টেবিলে খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে কোনো গোপন কথা না তারা শুনতে পেত, না কাউকে বলার প্রশ্ন উঠত। এভাবেই চলত ‘বার্লিন’।
সালটা ১৯৯৩। দীর্ঘ শীতল যুদ্ধ শেষ হয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। এমন সময় ভারত সফরে আসবেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। তাঁর সফরের আগে জানা যায়, প্রেসিডেন্টের সফরে হামলার ছক কষছে দুষ্কৃতকারীরা। সন্দেহের বশে গ্রেপ্তার করা হয় ‘বার্লিন’ ক্যাফের কর্মচারী অশোককে। কিন্তু এরপরেই বাধে গোল, অশোক মূক ও বধির, সে কী করে বিদেশি গুপ্তচর হতে পারে? অশোককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে আসে দিল্লির এক স্কুলশিক্ষক মূক ও বধির বিশেষজ্ঞ পুশকিনকে। অশোক কি সত্যিই অপরাধী? সে কি শেষ পর্যন্ত মুখ খুলবে? পুশকিন সাহায্য করতে এসেছে, নিজেও কি জড়িয়ে যাবেন রহস্যের জালে? এমন প্রশ্নের জট খুলতে খুলতে এগিয়ে যায় ‘বার্লিন’।
শীতের দিল্লির প্রেক্ষাপটে ‘বার্লিন’-এর গল্প ফেঁদেছেন নির্মাতা, যেখানে শহর, শীত আর পুরোনো দিল্লির আমেজ নিজেই চরিত্র হয়ে ওঠে; বলতে চায় অনেক কথাই। স্পাই-থ্রিলারের আড়ালে নির্মাতা দেখিয়েছেন রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিজেদের পিঠ বাঁচাতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে কীভাবে বলির পাঁঠা বানায়। কীভাবে তাদের নিছক খেলার ‘খেলনা’ হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ। ‘বার্লিন’ সিনেমাটিকে তাই ‘কন্সপিরেসি থ্রিলার’ বললেও ভুল হয় না।
‘বার্লিন’-এর প্রধান দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাহুল বোস ও অপারশক্তি খুরানা। দুর্দান্ত প্লট, গল্প বলা, পুরোনো দিল্লি তুলে ধরার সঙ্গে ছবির সবচেয়ে বড় সম্পদ এ দুজন, রাহুল আর অপারশক্তির পর্দার লড়াই দেখে চোখ ফেরানো যায় না। মনে হয়, এই রাহুল এত দিন ছিলেন কোথায়? অপারশক্তিকেই কেন নির্মাতারা কেবল সস্তা কমেডি করার জন্য ডাকেন?
‘বার্লিন’-এ নির্মাতা সম্ভবত সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্তভাবে হিন্দি স্পাই থ্রিলার সিনেমা। নির্মাতা অতুল অনেকটা অবাণিজ্যিক কায়দায় বানিয়েছেন সিনেমাটি, ফলে গল্পকে চলতে দিয়েছেন গল্পের মতো। কোনো চটক নেই, কিছুক্ষণ পরপর দর্শককে চমকে দেওয়ার চেষ্টা নেই; বরং গুপ্তচরদের শীতল পৃথিবীর গল্প তিনি বলে গেছেন ঠান্ডা মেজাজে।
এস্পিওনাজ বা স্পাই থ্রিলার সিনেমার সবচেয়ে জরুরি বিষয়, গুপ্তচরদের দুনিয়া যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করা। এখানেই বাজিমাত করেছেন অতুল। গোয়েন্দা সংস্থা আর সরকারি কর্মকাণ্ড নিয়েও তিনি সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন।
সিনেমায় একটা সংলাপ আছে, সত্য সেটাই যেটা রেকর্ডে থাকে। এই কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সিনেমার মেজাজ। ‘বার্লিন’-এ অতুল দেখিয়েছেন দেশ রক্ষার নামে বিভিন্ন সংস্থা কীভাবে সত্যকে ধামাচাপা দেয়। একই সঙ্গে উঠে এসেছে সরকারি দুই গোয়েন্দা সংস্থা ব্যুরো ও উইংয়ের দ্বন্দ্বও।
‘বার্লিন’ ভারতের সেরা স্পাই থ্রিলার কি না, এ নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। তবে এই ঘরানার সিনেমার তালিকা করলে ‘বার্লিন’ যে তালিকার ওপরের দিকেই থাকবে, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।