মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো সিন্ডিকেটের মূলহোতা ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী রুহুল আমিন দীর্ঘদিন ধরে অভিনব পন্থায় আয়কর ফাঁকি দিয়ে আসছেন।
কর্মী পাঠানোর বাড়তি টাকা ফির নামে প্রথমে মালয়েশিয়া পাঠাতেন তিনি, পরে ওই টাকা মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স হিসাবে বাংলাদেশে আনতেন। রেমিট্যান্সের অর্থ আয়করের আওতামুক্ত, তাই কর ফাঁকি দিতে এ পদ্ধতি বেছে নেন তিনি। এছাড়াও ঢাকায় তার একাধিক বিলাসবহুল বহুতল ভবন থাকলেও সেসব নির্মাণে বিনিয়োগের তথ্য এবং ভবন থেকে প্রাপ্ত ভাড়ার অর্থও রিটার্নে প্রদর্শন করেননি।
শর্ত পূরণ না করলেও বিনিয়োগ করেছেন ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডে। এদিকে দায় স্বীকার করে ৫ কোটি টাকা আয়কর পরিশোধ করেছেন তিনি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) তদন্তে এ চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় সব রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী পাঠাতে পারে না।
দেড় হাজারের বেশি রিক্রুটিং এজেন্সি থাকলেও কর্মী পাঠাতে পারত ১০০টির মতো এজেন্সি। এসব এজেন্সির নেতৃত্ব দিত ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল। কারণ মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে মাইগ্রাম নামের যে সফটওয়্যারে কর্মীদের নাম নিবন্ধন করতে হয়, সেটির মালিক মালয়েশিয়ার নাগরিক আমিনুল ইসলাম বিন আমিন নূর। এই আমিন নূরের সঙ্গে রুহুল আমিনের বিশেষ সখ্য ছিল।
তাই রুহুলের ইশারা ছাড়া কর্মী নিবন্ধন সম্ভব হতো না। কর্মীপ্রতি নিবন্ধন ফি ১০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত বা ২ হাজার ৭০০ টাকা থাকলেও কর্মীদের কাছ থেকে নেওয়া হয় প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার টাকা।
স্থানীয় আদায়কারী প্রতিষ্ঠান ৭ হাজার টাকা রেখে বাকি ১ লাখ টাকা অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে দিত। একই কায়দায় নামে-বেনামে চার্জ-ফি মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের কাছ থেকে আদায় করা হতো। অথচ মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকার নির্ধারিত জনপ্রতি ব্যয় ধরা হয় ৭৯ হাজার টাকা মাত্র।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, রুহুল আমিন তার আয়কর ফাইলে গৃহসম্পত্তি, ব্যবসা (জনশক্তি রপ্তানি) ও ব্যাংক সুদ আয় হিসাবে দেখিয়েছেন। যদিও ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩ করবর্ষে বিপুল পরিমাণ এফডিআর স্থিতি, ব্যাংক স্থিতি, গৃহসম্পত্তিতে বিনিয়োগ, ব্যাংক সুদ আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করেননি।
শুধু তাই নয়, কর ফাঁকি দিতে রিটার্নে ভুয়া ব্যাংক বিবরণীও জমা দেন তিনি। ২০১৭-১৮ করবর্ষে রিটার্নের সঙ্গে ব্যাংক স্থিতি দেখিয়েছেন ৮৫ লাখ ২১ হাজার টাকা, অথচ তার ব্যাংকে পাওয়া গেছে ৪ কোটি ৭ লাখ টাকা।
সিআইসি তদন্তে মালয়েশিয়া থেকে জনতা ব্যাংকের দুবাই শাখায় অর্থ স্থানান্তরের প্রমাণ পেয়েছে। যদিও রুহুল আমিন মালয়েশিয়া বা বিদেশে কখনো কর্মরত ছিলেন না। কাজের প্রমাণ/নিয়োগপত্র/কার্যাদেশ দাখিল করেননি রিটার্নে। সিআইসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রুহুল আমিন তার জনশক্তি ব্যবসার প্রাপ্তি বাংলাদেশে না এনে দুবাই ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্য দেশে পাচার করতেন।
সেই অর্থ দিয়ে ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড কিনেছেন। যদিও বিধিমালা অনুযায়ী একজন নিবাসী ব্যক্তি এ ধরনের বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারেন না। কিছু অর্থ বৈদেশিক রেমিট্যান্স হিসাবে বাংলাদেশে এনে করযোগ্য ব্যবসায়িক অন্য আয়কে রেমিট্যান্স হিসাবে দাবি করে বিপুল অঙ্কের আয়কর ফাঁকি দিয়েছেন।
কালো টাকা জমিতে বিনিয়োগ : রুহুল আমিন অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে জমি কেনেন। এসব জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণ করলেও সেই বিনিয়োগ রিটার্নে দেখাননি। যেমন ২০১৮-১৯ করবর্ষে বনানীতে দুই ভাইয়ের কাছ থেকে ৭ কাঠা জমি কেনেন। রিটার্নে জমির দলিলমূল্য দেখানো হয় রেজিস্ট্রিসহ ৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। অথচ দুই ভাইয়ের ব্যাংক হিসাবে রেজিস্ট্রির দিনে ৯ কোটি টাকার পে-অর্ডার করা হয়েছে। অর্থাৎ জমির প্রকৃতমূল্য গোপন করে আয়কর ফাঁকি ও রেজিস্ট্রি কর ফাঁকি দিয়েছেন তিনি।
এছাড়া বারিধারায় (বাসা-১২/ক, সড়ক-১০, ব্লক-কে) ৫ কাঠা জমির ওপর নির্মিত নেসা হাউজ নামে ৯ তলা বিশিষ্ট একটি বিলাসবহুল আবাসিক ভবন রয়েছে তার। এই ভবনে ৪টি ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট রয়েছে, যার একটিতে রুহুল আমিন থাকেন। ২০১৮-১৯ করবর্ষের আয়কর রিটার্নে জমির মূল্যসহ দালান নির্মাণের আংশিক খরচ দেখানো হয়েছে ৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। যদিও সিআইসি তদন্তে দেখতে পায়, ওই সময়ে পূর্ণাঙ্গ ভবন নির্মিত হয়।
২০১৮ সালের পহেলা জানুয়ারি বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানির কাছে সার্ভিস চার্জসহ মাসিক ৭ লাখ টাকায় দুটি ডুপ্লেক্স ভাড়া দেন। এছাড়া ডেসকো থেকে হাইভোল্টেজ বিদ্যুৎ লাইন নেন। গণপূর্ত অধিদপ্তরের হিসাবে এ ধরনের ভবন নির্মাণে জমিসহ দালান নির্মাণে খরচ হওয়ার কথা ৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ রুহুল আমিন এই ভবন নির্মাণে ৬ কোটি ৭১ লাখ টাকার বিনিয়োগ কম দেখিয়েছেন।
একইভাবে বনানীর (বাড়ি-১৩৩, রোড-১২, ব্লক-ই) ক্যাথারসিস টাওয়ার নির্মাণের বিনিয়োগও লুকিয়েছেন তিনি। ৭ কাঠা জমির ওপর ১৩ তলা বিশিষ্ট আবাসিক ভবন নির্মাণে ২০২২-২৩ করবর্ষে আংশিক খরচ দেখান ৯০ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। যদিও গণপূর্তের শিডিউল রেট অনুযায়ী ভবন নির্মাণের খরচ হওয়ার কথা ১৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে রুহুল আমিন ১৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ দেখাননি।
একই বছর উত্তরায় আরেকটি সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করলেও বিনিয়োগ লুকিয়েছেন তিনি। পশ্চিম উত্তরায় সোয়া ৫ কাঠা (প্লট-১৮, রোড-১২, সেক্টর-০৬, ওয়ার্ড-০১) জমির ওপর ১০ তলা বিশিষ্ট ভবনের আংশিক বিনিয়োগ দেখান ৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। গণপূর্তের শিডিউল রেট অনুযায়ী প্রকৃতপক্ষে খরচ হওয়ার কথা ১১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে ৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা বিনিয়োগ রিটার্নে দেখাননি।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এসব প্রপার্টি থেকে নিয়মিত ভাড়া আদায় করা হলেও আয়কর রিটার্নে সঠিক তথ্য প্রদর্শন করা হয়নি। ২০২০ সালে বনানীতে (বাড়ি-১১, রোড-২২, ব্লক-কে) ৩ তলা একটি বাড়ি ভাড়া দিলেও সেই অর্থ আয়কর নথিতে দেখাননি। প্রতিবছর এ বাড়ি থেকে ৪৮ লাখ টাকা ভাড়া নেন তিনি। তাছাড়া গাজীপুরের টঙ্গী ক্যাথারসিস মেডিকেল সেন্টারকে ১৫ কাঠা জমি মাসিক ২৫ হাজার টাকায় ভাড়া দিলেও সেটি আয়কর নথিতে দেখাননি।
টাকা সাদা করতেও জালিয়াতি : কালোটাকা সাদা করতেও জালিয়াতির আশ্রয় নেন রুহুল আমিন। ২০২০-২১ করবর্ষে ১০ শতাংশ (১৯এএএএএ ধারায়) হারে এক কোটি ৫ লাখ টাকা আয়কর দিয়ে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা বৈধ বা সাদা করেন তিনি। এ ধারার শর্ত ছিল-যে ক্ষেত্রে নগদ অর্থ প্রদর্শন করা হবে, সেক্ষেত্রে তা হাতে নগদ (ক্যাশ ইন হ্যান্ড) বা ব্যাংকে নগদ বা ব্যবসার পুঁজি হিসাবে প্রদর্শন করতে হবে।
আলোচ্য ক্ষেত্রে রুহুল আমিন টাকা সাদা করলেও তা নগদ বা আর্থিক উপকরণ হিসাবে প্রদর্শন করেননি। বরং আইনবহির্ভূতভাবে ওই অর্থ অতিরিক্ত মূলধন হিসাবে প্রারম্ভিক মূলধনের সঙ্গে যোগ করে দায় পরিশোধ করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে তিনি ৮ কোটি ৯১ লাখ টাকার দায় পরিশোধ করেন। আয়কর আইন অনুযায়ী, কালোটাকা সাদা করার শর্ত যথাযথভাবে পরিপালন না করায় ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকার ওপর নিয়মিত হারে (২৫ শতাংশ) আয়কর প্রযোজ্য হবে।
কর ফাঁকির অভিযোগের বিষয়ে ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের মালিক রুহুল আমিনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। জনশক্তি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তার ঘনিষ্ঠ ২ ব্যবসায়ী জানান, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তিনি কানাডা পাড়ি জমিয়েছেন।
পরবর্তীতে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেওয়া হলেও তিনি উত্তর দেননি। বৃহস্পতিবার তার পক্ষে ক্যাথারসিস গ্রুপের ম্যানেজার শাহা আযম যুগান্তরকে বলেন, সিআইসি দীর্ঘ এক বছর অনুসন্ধানের পর ফাইল সার্কেলে পাঠিয়েছে। প্রাথমিকভাবে কিছু টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। তবে তারা যেসব খাতে আয় দেখিয়েছে তার সঙ্গে আমাদের দ্বিমত রয়েছে। সার্কেল থেকে এখনো চূড়ান্ত নোটিশ ইস্যু করেনি। নোটিশ ইস্যু করলে আমরা শুনানিতে অংশ নেব। আমরা আমাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের চেষ্টা করব।
তিনি আরও বলেন, রহুল আমিন সাহেব কখনো কর ফাঁকি দেননি। মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর দায়িত্ব পাওয়ায় কিছু সংক্ষুব্ধ এজেন্সি তার বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন মহলে অযৌক্তিক অভিযোগ করছে। ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে যারা মালয়েশিয়া গিয়েছেন, তারা সবাই সেখানে কাজ করছেন।