পরতে পরতে নির্যাতনের চিহ্ন, আয়নাঘরে আরও যা দেখা গেল

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গড়ে ওঠা ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত গোপন নির্যাতনকেন্দ্র (টর্চার সেল) ও বন্দিশালা পরিদর্শন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।  

সেখানে বন্দিদের আটকে রাখার জন্য খুপড়ি, বৈদ্যুতিক চেয়ারসহ নির্যাতনের যন্ত্র, আটকে রাখা ব্যক্তিদের বিভিন্ন লেখা ও সাংকেতিক চিহ্ন দেখা গেছে।

বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস রাজধানীর কচুক্ষেত, উত্তরা, আগারগাঁও এলাকায় বিগত সরকারের তিনটি গোপন কারাগার পরিদর্শন করেন।  

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, গুম তদন্ত কমিশনের সদস্য, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি, আয়নাঘর থেকে প্রাণে বেঁচে ফেরা কয়েকজন ভুক্তভোগী ছিলেন।

ঢাকার আগারগাঁওয়ের একটি গোপন টর্চার সেল পরিদর্শনের সময় সেখানে প্রধান উপদেষ্টা বন্দিদের নির্যাতনের জন্য ব্যবহৃত একটি বৈদ্যুতিক চেয়ার দেখতে পান। এর মাধ্যমে বন্দিদের বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো।

গোপন বন্দিশালায় ছোট ছোট কক্ষ দেখা যায়। নোংরা-স্যাঁতসেঁতে এসব কক্ষে অমানবিক ও বিচারবর্হিভূতভাবে বন্দিদের আটকে রাখা হতো। কোনো কোনো কক্ষের দেওয়ালে লেখা দোয়া, সাংকেতিক চিহ্ন দেখতে পাওয়া গেছে।  

বন্দিদের দিন, মাস, বছর গণনার চিহ্ন, মাসুদ, ইব্রাহিমসহ বেশ কিছু নাম, ‌আই লাভ মাই ফ্যামিলি, ১৬৩, ১৫০, ১১৩, ১২৩০ ইত্যাদি সংখ্যা ঘরের দেওয়ালে লেখা রয়েছে। এ ছাড়া আয়নাঘরে বন্দিদের রাখার জায়গা ছাড়াও জিজ্ঞাসাবাদের কক্ষ, বেশ কয়েক বান্ডেল নগদ টাকা ও মদের বোতল পাওয়া গেছে।

বিভিন্ন সময় বন্দিদের আটকে রাখা এবং নির্যাতনের প্রমাণ মুছে দিতে বন্দিশালার কক্ষের দেওয়াল ভাঙার চিহ্ন রয়েছে। এর পাশাপাশি নতুন করে রঙ করা এবং অবকাঠামোগত পরিবর্তনের চিহ্নও দেখতে পাওয়া গেছে।

এখনো যেসব প্রমাণ অবশিষ্ট আছে, তা অক্ষত রাখতে আয়নাঘর সিলগালা করে রাখার নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস।

এক দশক আগে মাত্র ১১ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে গুমের শিকার হন আফসানা নূরে আলিয়া। পরে ছোট এই মেয়ে আয়নাঘর থেকে মুক্তি পায়। তবে এখনো মুক্তি মেলেনি তার মায়ের। আলিয়া প্রধান উপদেষ্টার কাছে তার করুণ স্মৃতির কথা তুলে ধরে মায়ের সন্ধান চান এবং অপরাধীদের বিচার চান।

জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের গোপন টর্চার সেলে (আয়নাঘর) আটকে রাখা হয়েছিল।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আয়নাঘর পরিদর্শনে যান অন্তর্বর্তী সরকারের এই দুই উপদেষ্টা। তাদের যেসব কক্ষে তাদের আটকে রাখা হয়েছিল, সেগুলো দেখে চিনতে পারার কথা জানান তারা।

আয়নাঘর পরিদর্শনের পর নাহিদ জানান, তাকে যে কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল, সেই কক্ষের একপাশে টয়লেট হিসেবে একটি বেসিনের মতো ছিল। ৫ আগস্টের পর এই সেলগুলোর মাঝের দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়, দেয়াল রং করা হয়।

আসিফ মাহমুদ জানান, তিনি দেয়াল দেখে কক্ষটিকে চিনতে পেরেছেন। কক্ষটি আগে অনেক ছোট ছিল, এখন মাঝের দেয়াল ভেঙে বড় করা হয়েছে। ওই কক্ষে তাকে চারদিন আটকে রাখা হয়েছিল। এ সময় বাইরের কারো সঙ্গে তাকে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। টয়লেট ছিল কক্ষের বাইরে এবং তাকে চোখ বেঁধে টয়লেটে নিয়ে যাওয়া হতো।

বহু বছর আয়নাঘরে বন্দি থাকা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ আজমী, ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাশেম আরমান,  হুম্মাম কাদের চৌধুরী তাদের বন্দিজীবনের কথা তুলে ধরেন। যেসব কক্ষে তাদের বন্দি রাখা হয়েছিল, সেগুলো দেখতে পান তারা। কিভাবে বন্দী রাখা হয়, কিভাবে নির্যাতন করা হয়, সেসবের বর্ণনা দেন তারা।

আয়নাঘরে খাঁচার মতো জায়গায় যেখানে বন্দিদের আটকে রাখা হতো, সেসব জায়গা ঘুরে দেখেন প্রধান উপদেষ্টা। পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, গত সরকার আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগ প্রতিষ্ঠা করে গেছে, যার একটি নমুনা আয়নাঘর।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এটি কি আমাদেরই সমাজ? এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। যতই শুনি, অবিশ্বাস্য মনে হয়। যারা নির্যাতিত হয়েছেন, তারাও আমাদের সঙ্গে এসেছে, তাদের মুখেই শুনলাম।

বিনা দোষে কতগুলো সাক্ষী নিয়ে, হাতে এক্সপ্লোসিভ ধরিয়ে দিয়ে কাউকে সন্ত্রাসী-জঙ্গি বলে রাখা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের বিনা কারণে, বিনা দোষে উঠিয়ে আনা হতো। সন্ত্রাসী, জঙ্গি বলে এখানে ঢুকিয়ে রাখা হতো।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই রকম টর্চার সেল (নির্যাতনকেন্দ্র) সারা দেশে আছে। ধারণা ছিল এখানে কয়েকটি আছে। এখন শুনছি বিভিন্ন ভার্সনে (সংস্করণে) সারা দেশে আছে। সংখ্যাও নিরূপণ করা যায়নি। কেউ বলে ৭০০, কেউ বলে ৮০০।

মানুষকে সামান্যতম মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একজন বলছিলেন খুপরির মধ্যে রাখা হতো। মুরগির খাঁচাও তো এর চেয়ে বড় হয়। বছরের পর বছর এভাবে রাখা হয়েছে।

গুম-খুনের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সমাজ টিকবে না উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা নতুন সমাজ গড়া, অপরাধীদের বিচার করা, প্রমাণ রক্ষার ওপর জোর দেন।

গুমের শিকার ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ন্যায়বিচার যেন পায়, সেটিই এখন প্রাধ্যান্য পাবে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা নতুন বাংলাদেশ ও নতুন পরিবেশ গড়তে চাই। সরকার সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন কমিশন করেছে। যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেসবের পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সরকার সে লক্ষ্যে কাজ করবে।

  • Related Posts

    চাপ দিয়ে উপাচার্যকে অপসারণ করা হলে মানবে না শিক্ষক সমিতি কুয়েট

    চাপ দিয়ে উপাচার্যকে অপসারণ করা হলে তা মেনে নেবে না কুয়েট শিক্ষক সমিতি। সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে তারা। এছাড়া শিক্ষা উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা…

    Continue reading
    দোহায় গোলটেবিল আলোচনায় ড. ইউনূস রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান টেকসই প্রত্যাবাসন

    রোহিঙ্গা সংকট কেবল একটি মানবিক সমস্যা নয়; এটি একটি বহুমাত্রিক সংকট, যার সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাব রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।…

    Continue reading

    চাপ দিয়ে উপাচার্যকে অপসারণ করা হলে মানবে না শিক্ষক সমিতি কুয়েট

    চাপ দিয়ে উপাচার্যকে অপসারণ করা হলে মানবে না শিক্ষক সমিতি কুয়েট

    দোহায় গোলটেবিল আলোচনায় ড. ইউনূস রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান টেকসই প্রত্যাবাসন

    দোহায় গোলটেবিল আলোচনায় ড. ইউনূস রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান টেকসই প্রত্যাবাসন

    দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন কাশ্মীরে হামলা: ভারত-পাকিস্তান ফের সংঘাতের আশঙ্কা

    দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন কাশ্মীরে হামলা: ভারত-পাকিস্তান ফের সংঘাতের আশঙ্কা

    কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলা সৌদি সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরছেন মোদী

    কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলা সৌদি সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরছেন মোদী

    কুয়েটে অনশনরত শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষা উপদেষ্টা

    কুয়েটে অনশনরত শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষা উপদেষ্টা

    কুমিল্লা ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে ৩জনের মর্মান্তিক মৃত্যু

    কুমিল্লা ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে ৩জনের মর্মান্তিক মৃত্যু

    অবশেষে উইকেটের দেখা পেল হারের শঙ্কায় থাকা বাংলাদেশ

    অবশেষে উইকেটের দেখা পেল হারের শঙ্কায় থাকা বাংলাদেশ

    বাংলাদেশ অলআউট ২৫৫ রানে, জিততে হলে জিম্বাবুয়ের দরকার ১৭৪

    বাংলাদেশ অলআউট ২৫৫ রানে, জিততে হলে জিম্বাবুয়ের দরকার ১৭৪

    কাতারে ড. ইউনূস ও বিখ্যাত অভিনেতা ইদ্রিস এলবার সাক্ষাৎ

    কাতারে ড. ইউনূস ও বিখ্যাত অভিনেতা ইদ্রিস এলবার সাক্ষাৎ

    কাশ্মীরে হামলায় শোক আর ক্ষোভে উত্তাল বলিউড

    কাশ্মীরে হামলায় শোক আর ক্ষোভে উত্তাল বলিউড