দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে দুর্নীতি কিভাবে গ্রাস করেছে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার একটি মন্তব্যেই তা বোঝার জন্য যথেষ্ট। গত সপ্তাহে তিনি বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। দেশের প্রধান এই ক্রীড়াভেন্যুর দোকানগুলোর ভাড়ার হারে অসামঞ্জস্য দেখে তিনি নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘মনে হচ্ছে আমাকে এনে কেউ দুর্নীতির মহাসাগরে ছেড়ে দিয়েছে।’
দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবক আরো লিখেছিলেন, ‘দোকানদাররা ভাড়া দেন প্রতি বর্গফুট ১৭০ থেকে ২২০ টাকা করে। আর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পায় বর্গফুট ২০ থেকে ২২ টাকা করে। বিশাল অংকের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে সরকারের। এভাবে বছরের পর বছর হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি গেছে।’
যুগের পর যুগ এভাবেই চলে আসছে, দোকানদাররা ভাড়া ঠিকই দিচ্ছেন, পাচ্ছে না সরকার। যখনই নতুন সরকার এসেছে, তখনই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অধিনস্থ দোকানগুলোর অবিশ্বাস্য কম ভাড়ার কথা সামনে এসেছে। তবে রহস্যজনকভাবে কোনো আমলেই এ সমস্যার সুরাহা হয়নি।
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা পদাধিকার বলে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদেরও চেয়ারম্যান। আগে কোনো চেয়ারম্যান এভাবে স্টেডিয়ামের দোকানে গিয়ে ভাড়ার বিষয়টির খোঁজখবর নেননি। আগের চেয়ারম্যানরা দায়িত্ব নেওয়ার পর গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে এই অনিয়মের বিষয়টি জেনে ‘সব ঠিক করে দিচ্ছি’ বলে ফাঁকা আওয়াজ তুলতেন। তবে ক্রীড়াঙ্গন বদলায়নি, সময়ের প্রেক্ষাপটে তারাই বদলে গেছেন। অনিয়ম রয়ে গেছে অনিয়মের জায়গাই। অনিয়মের পরিমাণ দিনদিন বেড়েছেই।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফসল বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যে সরকারের সময়ে ক্রীড়াঙ্গন অভিভাবক হিসেবে পেয়েছে তরুণ আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে, যিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। তিনি সরেজমিনে স্টেডিয়ামের দোকান পরিদর্শন করে ভাড়ার অসামঞ্জস্যতা খুঁজে পেয়েছেন। সবার প্রত্যাশা এবার হয়তো সরকার প্রকৃত ভাড়া পাবে দোকানগুলো থেকে।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বরাদ্দ দেওয়া এই দোকানগুলোর যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রায় তিন যুগ আগে, সেটা বেড়েছে মাত্র ১০ টাকার মতো। যারা বরাদ্দ নিয়েছেন, তারা ওই হারে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে ভাড়া দেয়। আর তারা দোকানদারদের কাছ থেকে ভাড়া নেয় ৬ থেকে ৭ গুণ বেশি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশিরভাগ দোকানই কয়েকবার হাত বদল হয়েছে। যতবার হাত বদল হয়েছে ততবার লাভবান হয়েছে বরাদ্দ নেওয়া ব্যক্তিরা। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে জমা হয় নামকাওয়াস্তের ভাড়া। অভিযোগ আছে ‘লাভের গুড়’ খাওয়াদের তালিকায় আছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বিষয়টি দেখভাল করা কিছু অসাধু কর্মকর্তাও। যে কারণে কয়েক বছর পরপর দোকানভাড়া নিয়ে কথা উঠলেও সেটা আবার ধামাচাপা পড়ে যায়।
এমন অনিয়মের কাহিনী শোনা যায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সব স্থাপনায় থাকা দোকান নিয়েই। তবে পুরনো ও সবচেয়ে ভালো পজিশনে বলে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের দোকানের কথাই বেশি সামনে আসে। রাজধানী ঢাকায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের স্থাপনা আছে ৮ টি। এর মধ্যে পল্টনেই আছে ৫টি- বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, মওলানা ভাসানী স্টেডিয়াম, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম সংলগ্ন সুপার মার্কেট, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম সংলগ্ন সুইমিংপুল মার্কেট ও ভলিবল স্টেডিয়াম। এছাড়া আছে কমলাপুরস্থ বীর শ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম, মিরপুর শের-ই বাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম, মিরপুর শের-ই বাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম সংলগ্ন আউটার মার্কেট। এই ৮ স্থাপনায় রয়েছে ১০৭৪ টি দোকান। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে দোকান আছে ২৯৫ টি।
সংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলো নির্মাণের পরই সেখানকার দোকানগুলো বরাদ্দ দিয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। বরাদ্দ গ্রহিতাদের কাছ থেকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ তাদের নির্ধারিত হারে ভাড়া গ্রহণ করে। এ ভাড়া সময়ে সময়ে হালনাগাদের কথা থাকলেও সেটা হয় না। আবার দেখা গেছে, হালনাগাদ হয়ে ভাড়ার হার বৃদ্ধির পরিবর্তে কমানো হয়েছে। এটাই প্রমাণ করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সরকারের রাজস্বের পরিবর্তে দোকান বরাদ্দ গ্রহীতা ও নিজেদের স্বার্থকেই বড় করে দেখেছেন।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বরাদ্দ দিয়েছে দোকান; কিন্তু যারা বর্তমানে ভাড়াটিয়া তারা দোকানের পাশাপাশি ব্যবহার করে বারান্দাও। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের বারান্দা দিয়ে হাঁটাচলা করাই কঠিন। এমনকি এ স্টেডিয়ামে যখন বড় বড় ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়, জাতীয় প্রতিযোগিতা হয় তখন দর্শকরা স্টেডিয়ামে প্রবেশের গেটই খুঁজে পান না দোকানগুলোর বারান্দা দখল করে রাখা মালামালের কারণে।
এক সময় দর্শকদের দ্রুত প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য অনেক গেট ছিল। ছিল পর্যন্ত টয়লেট। সেগুলোও পর্যায়ক্রমে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বরাদ্দ দিয়েছে দোকান হিসেবে। দেশের প্রধান এই ক্রীড়াভেন্যুতে খেলাধুলার কোনো পরিবেশই নেই। যেন ব্যবসার জন্যই তৈরি হয়েছিল এই স্টেডিয়ামটি।
এমন অনিয়ম দেখে স্বয়ং ক্রীড়া উপদেষ্টা যখন হতাশ হয়ে নিজেকে আবিস্কার করলেন ‘দুর্নীতির মহাসাগরে’, তখন আর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বসে থাকার সুযোগ কোথায়? ক্রীড়া উপদেষ্টার নির্দেশে স্টেডিয়ামের মালিক একটু নড়েচড়ে বসেছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ একটি কমিটি গঠন করে ক্রীড়া স্থাপনার দোকানগুলোর ভাড়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, দোকানগুলো কোন প্রক্রিয়ায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, কোনো চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল কিনা, চুক্তি স্বাক্ষর হলে সেখানে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের স্বার্থ সমুন্নত ছিল কিনা, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কতটা লাভবান হয়েছে, প্রকৃত বরাদ্দ গ্রহীতা কারা, ভাড়াটিয়ারা বরাদ্দ গ্রহীতাদের কি পরিমাণ ভাড়া দিচ্ছে, বরাদ্দপত্র পর্যালোচনার সুযোগ আছে কিনা- এসব বিষয়ের আইনগত দিক খতিয়ে দেখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে তারা। ওই কমিটির মতামত ও সুপারিশের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবক প্রতিষ্ঠানটি।