অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান প্রবাসীদের। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রবাসীদের উল্লাস ছেয়ে যায় দেশ থেকে দেশান্তরে। এরপর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হলো অন্তর্বর্তী সরকার। নবগঠিত এই সরকারকে নিয়ে দেশবাসীর সঙ্গে আশা-আকাঙ্ক্ষা কম নয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশির।
দেশের অর্থনীতিতে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি তারাই সবচেয়ে অবহেলিত। শেখ হাসিনা সরকারের টানা তিন মেয়াদে তেমন কোনো পরিবর্তন নেই বললেই চলে। বিমানবন্দরের হয়রানি থেকে শুরু করে দূতাবাসগুলোতেও ছিল না কাঙ্ক্ষিত সেবা। প্রবাসীদের আশা অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত তাদের এই দাবিগুলো পূরণে ভূমিকা রাখবে। হয়রানিমুক্ত হোক প্রবাসীরা।
প্রবাসীদের দাবিসমূহ
১। বিমানবন্দরে হয়রানি বন্ধ করতে হবে
২। দালালমুক্ত পাসপোর্ট ও দূতাবাস সেবা নিশ্চিত করতে হবে
৩। বিনামূল্যে প্রবাসীদের মরদেহ দেশে পাঠানো ব্যবস্থা করতে হবে
৪। সুদমুক্ত ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে
৫। বিমানের টিকিট সিন্ডিকেট রোধ করতে হবে
৬। প্রবাসীদের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে
৭। অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে
৮। ব্যাংকে প্রণোদনা বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু দাবি জানান প্রবাসীরা
কুয়েত প্রবাসী মুস্তাকীম বলেন, দালাল ছাড়া আমরা কোনো সেবা পাই না। আমি বিদেশ আসার আগে পাসপোর্ট বানানো লাগছে দালালকে দিয়ে। এরপর পুলিশ ক্লিয়ারেন্সে আমার দিতে হয়েছে ২৫০০ টাকা। যে সেবাটা আমার সরকারিভাবে পাওয়ার কথা সেটা আমার টাকা দিয়ে করা লাগে। এরপর বিদেশে এসে দূতাবাস থেকেও কাঙ্ক্ষিত সেবা পাই না।
তিনি বলেন, কুয়েতে ক্লিনিং কোম্পানিগুলোতে অধিকাংশ প্রবাসী বাংলাদেশিরা কাজ করে মাসের পর মাস যখন বেতন না পায়, তখন তারা দ্বারস্থ হন কুয়েতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে। কিন্তু দূতাবাস তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয় না। উল্টা ওসব কোম্পানির সঙ্গে দূতাবাসের কিছু কর্মকর্তা ভালো সম্পর্ক থাকে। অথচ আমাদের পাশের দেশ ভারত, নেপাল, ভুটানের প্রবাসীরা যদি কুয়েতের মাটিতে কোনো ধরনের বেতন-ভাতা নিয়ে সমস্যায় পড়েন তখন তাদের দূতাবাস সরাসরি মাঠ পর্যায়ে এসে পদক্ষেপ নেয়। আমরা চাই দালালমুক্ত পাসপোর্ট ও দূতাবাস সেবা।
আরেক কুয়েত প্রবাসী শেখ নূর হোসাইন বলেন, একজন মানুষকে প্রবাসে আসার শুরু থেকে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। বিভিন্ন জায়গায় দালাল দিয়ে ভরা। আমরা চাই প্রতিটি জায়গায় দালালমুক্ত হোক। বিশেষ করে এয়ারপোর্টে পদে পদে হয়রানি শিকার হতে হয় প্রবাসীদের। ফলে অনেক প্রবাসী বিভ্রান্তিতে পড়েন। আমরা চাই বিমানবন্দরে এই প্রবাসী হয়রানি বন্ধ হোক এবং প্রবাসীদের সঠিক মূল্যায়ন করা হোক। প্রবাসীদের মূল্যায়ন করা হলে দেশের রেমিট্যান্স আরও অনেকাংশেই বেড়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি জানান, বিমানের টিকিটের বিষয়টা নতুন সরকারের ভেবে দেখা উচিত। অনেক প্রবাসী সীমিত বেতনে চাকরি করে কয়েক বছর পর দেশে যায়। অথচ টিকিট কিনতে তাকে দুই থেকে তিন মাসের বেতন জমা রাখা লাগে। সিন্ডিকেটের কারণে টিকিটের দাম তিনগুণ বেড়ে যায়। যা খুবই দুঃখজনক।
বন্ধন প্রবাসী কল্যাণ সংস্থার সভাপতি নূরুল আমিন বকস বলেন, প্রবাসীদের মরদেহ সরকারিভাবে বহন করলে প্রবাসীদের উপকারে আসবে। যেমন অনেক প্রবাসী আছে মারা যাওয়ার পর প্রবাসে চাঁদা উঠিয়ে টিকিটের টাকা ব্যবস্থা করতে হয়। না হয় দেশ থেকে জায়গা জমি থাকলে বিক্রি করে লাশ দেশে নেওয়া লাগে। অনেক প্রবাসীর লাশ হিমঘরে পড়ে থাকে দিনের পর দিন।
তিনি জানান, বাংলাদেশের এনজিও সংস্থাগুলো বেশি মুনাফা নিয়ে প্রবাসীদের ঋণ দিয়ে যাচ্ছে শর্তহীনভাবে। প্রতি লাখে মাসে নিয়ে যাচ্ছে ১০ হাজার টাকা। এতে এনজিও সংস্থা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রবাসীরা। আমাদের প্রবাসী ব্যাংক শর্তহীনভাবে যদি আমাদের ঋণ দেয় তাহলে প্রবাসীরা উপকৃত হবে। আমরা চাই প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক আমাদের সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করুক।
বাংলাদেশ প্রবাসী অধিকার পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক রবিউল হক বলেন, আমাদের প্রবাসীদের বড় সমস্যা হচ্ছে অভিবাসন ব্যয়। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে আমাদের প্রায় ছয়গুণ অর্থ বেশি দিয়ে প্রবাসে আসতে হয়। বাংলাদেশ সরকার এবং আমাদের দূতাবাস ইচ্ছে করলে কূটনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে আমাদের অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনতে পারবে। দেখা যায় যারা ভিসার ব্যবসার সাথে জড়িত মূলত তারাই ভিসার দামের বৃদ্ধির জন্য দায়ী।
তিনি বলেন, অল্প খরচে যদি আমরা প্রবাসে আসতে পারি তাহলে অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে প্রবাসীরা মুক্ত থাকবে। ফলে বাংলাদেশে আরও বেশি বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবে। শেখ হাসিনা সরকার থাকাকালীন আমাদের রেমিট্যান্সের ওপর ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার কথা থাকলেও দেয়নি। তাই সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি আমাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ৫ শতাংশ প্রণোদনা যেন দেওয়া হয়।