গ্রামের ভেতরে বিশাল খেলার মাঠ। মাঝবয়সী নারীর বাঁ হাতে শক্ত করে ধরা বাঁকা ধনুক আর ডান হাতে সুচালো তির। চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সামনে ৮০ ফুট দূরে পুঁতে রাখা কলাগাছে। ধনুকের বাণ থেকে ছুড়তেই তড়িৎ গতিতে সেই তির বিঁধল কলাগাছে। সাঁওতাল নারীর তির-ধনুকের এমন দক্ষতা দেখে মুগ্ধ দর্শকসারিতে থাকা শত শত নারী, পুরুষ ও শিশু।
গতকাল শুক্রবার দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার সাঁওতালপল্লির সোনাজুড়ি ফুটবল মাঠে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়েছে তিরন্দাজি প্রতিযোগিতা। উপজেলার ৩ নম্বর খানপুর ইউনিয়নের সাঁওতাল–অধ্যুষিত রতনপুর এলাকার জবচ্ মানঝি পরিষদের উদ্যোগে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে আয়োজক সংগঠনের সভাপতি বার্নাবাস হেম্ব্রমের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন ধানজুড়ি ক্যাথলিক চার্চের সহকারী পালপুরোহিত রতন মুরমু। ব্রিটিশবিরোধী সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মৃতি, আত্মরক্ষার কৌশল ও বন্য প্রাণী শিকারে দেশীয় অস্ত্র হিসেবে তির-ধনুক ব্যবহারের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতেই এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে।
প্রতিযোগিতায় দিনাজপুরের বিরামপুর, নবাবগঞ্জ, ফুলবাড়ী, দিনাজপুর সদর ও বোচাগঞ্জ উপজেলা থেকে ১৬টি পুরুষ দল ও ৮টি নারী দল অংশগ্রহণ করে। প্রতিটি দলে ৭ জন করে মোট ১৬৮ জন তিরন্দাজ অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে ৫৬ জন নারী তিরন্দাজের তির নিক্ষেপ ছিল প্রতিযোগিতার বিশেষ আকর্ষণ। তির নিক্ষেপে দর্শকদের চমক দেখিয়েছেন অঞ্জলি হাসদা, সেনসা সরেন, জাচিনা হেম্ব্রম, সান্ত্বনা কিস্কু, মার্থা হেম্ব্রম, রিতা বাস্কে ও জয়ন্তি মার্ডির মতো ডজনখানেক নারী তিরন্দাজ। নারী তিরন্দাজের হাতে থাকা ধনুকের বাণ লক্ষ্য ভেদ করামাত্রই মাঠের চারপাশের দর্শক বাহবা আর করতালিতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। পুরুষ তিরন্দাজের জন্য ১০০ ফুট দূরে এবং নারী তিরন্দাজের জন্য ৮০ ফুট দূরে লক্ষ্যবস্তু কলাগাছ পুঁতে রাখা হয়েছিল।
অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী সেনসা সরেন বলেন, ‘আমি খেলাটি শিখেছি আমার মা-বাবার কাছ থেকে। অনেক দিনের আশা ছিল, আমরা তির-ধনুক খেলব। নারীরা আজ কোনো কিছুতেই পিছিয়ে নেই। পড়াশোনা থেকে শুরু করে খেলাধুলা, সবকিছুতেই আমরা আছি।’
তির-ধনুক হচ্ছে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের একটি ঐতিহ্য। সাঁওতাল পরিবারের যুবকেরা প্রতিবছর একবার করে হলেও তির-ধনুক নিয়ে শিকারে বের হন।
শিশির হেম্ব্রম, তিরন্দাজি প্রতিযোগিতার আয়োজক কমিটির সমন্বয়ক
পুরাতন ধানজুড়ি দল থেকে অংশ নেওয়া নারী তিরন্দাজ অঞ্জলি হাসদা বলেন, ‘আমরা শুনেছি এ প্রতিযোগিতায় নারীদের অংশগ্রহণ করতে হবে। সে অনুযায়ী আমরা খেলায় অংশ নিচ্ছি। খেলায় জিততেই হবে, প্রাইজ নিতেই হবে, এটি আমাদের টার্গেট নয়।’
খানপুর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্য শীতলী রানী পাহান বলেন, এ মাঠে তির-ধনুকের খেলা এটিই প্রথম। খেলা দেখতে পেরে তিনি খুবই আনন্দিত।
তিরন্দাজি প্রতিযোগিতার আয়োজক কমিটির সমন্বয়ক শিশির হেম্ব্রম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তির-ধনুক হচ্ছে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের একটি ঐতিহ্য। সাঁওতাল পরিবারের যুবকেরা প্রতিবছর একবার করে হলেও তির-ধনুক নিয়ে শিকারে বের হন। এই অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে যেন সব সময় তুলে ধরতে পারি।’
প্রতিযোগিতা শেষে পুরুষদের গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন মহেশপুর বোচাগঞ্জ দলকে উপহার হিসেবে একটি বড় খাসি ও রানার্সআপ কালীহাট জয়পুর দলকে একটি ছোট খাসি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। আর নারীদের গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন পুরাতন ধানজুড়ি দলকে নগদ ১ হাজার ৭০০ টাকা এবং রানার্সআপ সোনাজুড়ি দলকে ১ হাজার ৩০০ টাকা পুরস্কার দেওয়া হয়।