বাংলা সঙ্গীতাঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা। অসংখ্য গান গেয়ে মানুষের মন জয় করে আছেন তিনি। আজ ১১ সেপ্টেম্বর প্রথিতযশা এ কণ্ঠশিল্পীর জন্মদিন। ১৯৬৯ সালের আজকের এই দিনে ঢাকার শান্তিবাগে জন্ম কনকচাঁপার। তার দাদার বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে। তবে কনকচাঁপার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। তার বাবার নাম আজিজুল হক মোর্শেদ। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে কনকচাঁপা তৃতীয়। অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়ে তিনি বাংলা গানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। চলচ্চিত্র, আধুনিক গান, নজরুল সঙ্গীত, লোকগীতিসহ সব ধরনের গানে কনকচাঁপা সমান পারদর্শী।
‘কি জাদু করেছো বলো না’, ‘একবিন্দু ভালোবাসা দাও’, ‘ভালো আছি ভালো থেকো’, ‘তোমায় দেখলে মনে হয়’, ‘আকাশ ছুঁয়েছে মাটিকে’, ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’, ‘তুমি আমার এমনই একজন’, ‘অনেক সাধনার পরে আমি পেলাম তোমার মন’, ‘এই বুকে বইছে যমুনা’, ‘নীলাঞ্জনা নামে ডেকনা’- এমনি অসংখ্য জনপ্রিয় গানের নন্দিত কণ্ঠশিল্পী কনকচাঁপা। একেবারে ছোটবেলাতেই তার গানে হাতে খড়ি। রেডিওতে কলকাকলি অনুষ্ঠান দিয়ে গান গাওয়া শুরু। বাংলাদেশ টেলিভিশনের নতুন কুঁড়ি অনুষ্ঠানে ১৯৭৮ সালে পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কার।
তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এ কণ্ঠশিল্পী চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েই শ্রোতাদের মনে ঠাঁই করে নিয়েছেন। নিজেকে সব সময় একজন কণ্ঠশ্রমিক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন সঙ্গীতের এই বিরল প্রতিভা। আমাদের সঙ্গীত-বাগানে কনকচাঁপা যেন বৈচিত্র্যময় সৌরভ ছড়ানো এক ফুল। সঙ্গীতাকাশের উজ্জ্বলতম এক নক্ষত্র।
জন্মদিন উদযাপন প্রসঙ্গে কনকচাঁপা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই জন্মদিন পালন করার অভ্যাস ছিল না। সত্যিকার অর্থেই জন্মদিনের প্রতি আলাদা কোনো দুর্বলতা আমার নেই। আমরা তো মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। ছোটবেলায় মা হয়তো একটু পায়েস রান্না করে খাওয়াতেন। তখন তো কেকটেকের কালচারই ছিল না। পারিবারিকভাবেই আসলে কখনোই ঘটা করে আমরা জন্মদিন পালন করিনি বা করি না। তবে বাচ্চারা যখন বড় হয়েছে তখন তারা ১২টা ১ মিনিটে মায়ের জন্য কেক কেটে জন্মদিন পালন করে। সেটাও ঘরোয়াভাবে।’ এখন জন্মদিন আসা মানেই জীবন থেকে আরও একটা বছর চলে যাওয়া। এটা ভাবতেই মনের ভেতর কষ্ট হয়। কাজের মাঝেই এবং কাজের জন্যই আমার জন্ম। কেননা আমি একজন আপাদমস্তক কণ্ঠশ্রমিক।
তিনি আরও বলেন, কর্মহীন দীর্ঘজীবন আমার খুবই অপছন্দ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকতে চাই, গানের সঙ্গে, সত্যের সঙ্গে, ভালো কাজের সঙ্গে থাকতে চাই। আমার জন্মদিন এবং মৃতু্যদিন পালন করা হবে সেটি আমি কখনোই চাই না। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত যেন সুস্থ থাকতে পারি সৃষ্টিকর্তার কাছে এটাই প্রার্থনা। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।’
কনকচাঁপা দীর্ঘ ক্যারিয়ারে এ পর্যন্ত চলচ্চিত্রের তিন হাজারেরও বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন কনকচাঁপা। প্রকাশিত হয়েছে ৩৫টি একক গানের অ্যালবাম। কনকচাঁপা বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী বশীর আহমেদের ছাত্রী। দীর্ঘদিন তার কাছে উচ্চাঙ্গ, নজরুল সঙ্গীতসহ অন্যান্য ভারতীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন। বর্তমানে পেস্ন-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে নিয়মিত কাজ করছেন তিনি। তার ৩৫টি একক গানের অ্যালবাম রয়েছে। চলচ্চিত্রের গান নিয়ে তার সর্বশেষ প্রকাশিত অ্যালবাম ‘আবার এসেছি ফিরে’।
সঙ্গীতশিল্পীর বাইরে লেখক হিসেবেও তার সুখ্যাতি রয়েছে। ২০১০ সালের অমর একুশে বইমেলায় ‘স্থবির যাযাবর’, ২০১২ সালের বইমেলায় ‘মুখোমুখি যোদ্ধা’ ও ২০১৬ সালের বইমেলায় ‘মেঘের ডানায় চড়ে’ নামে তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে কনকচাঁপার।
কনকচাঁপার জনপ্রিয় গানের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অনেক সাধনার পরে আমি পেলাম তোমার মন, তোমাকে চাই শুধু তোমাকে চাই, ভালো আছি ভালো থেকো, যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে জীবনে অমর হয়ে রয় (খালিদ হাসান মিলুর সঙ্গে), আমার নাকেরই ফুল বলে রে তুমি যে আমার, তোমায় দেখলে মনে হয়, আকাশ ছুঁয়েছে মাটিকে, অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে, তুমি আমার এমনই একজন।
গানের জন্য রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছাড়াও বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার, দর্শক ফোরাম পুরস্কার, প্রযোজক সমিতি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা পেয়েছেন।
‘যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে/জীবনে অমর হয়ে রয়। সেই প্রেম আমাকে দিও, জেনে নিও/তুমি আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয়।’ -মনের মানুষকে নিয়ে এটি কনকচাঁপার গাওয়া অন্যতম জনপ্রিয় একটি গান। বাংলার সঙ্গীতাঙ্গনে এই গানের মতোই সুরের যেই সৌরভ ছড়িয়ে দিয়েছেন কনকচাঁপা, তা বহুকাল সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে। একইভাবে সুরের এই রাজকন্যা তার অনন্য কণ্ঠবীণায় আরও দীর্ঘ সময় আমাদের সঙ্গীতপিপাসুদের মন রাঙিয়ে যাবেন। সুরে-গানে আরও আলোকিত করবেন বাংলার সঙ্গীত ভুবন।