ডিসেম্বরে নির্বাচন চায় মাত্র একটি দল নিক্কেই ফোরামে ড. ইউনূস

বাংলাদেশের সব দল নয়, মাত্র একটি রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন চায় বলে দাবি করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৃহস্পতিবার টোকিওর ইম্পেরিয়াল হোটেলে ৩০তম নিক্কেই ফোরাম ‘ফিউচার অব এশিয়া’র উদ্বোধনী অধিবেশনের মূল বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। খবর জাপান টাইমসের।

ড. ইউনূস বলেন, আমার কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই আমার প্রধান লক্ষ্য। মানুষের ন্যায়বিচার, সমতা, স্বাধীনতা, মর্যাদা নিশ্চিত এবং গণতন্ত্র মসৃণ রূপান্তরের লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। 

সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন- এ তিনটি দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকার পালন করবে জানিয়ে তিনি বলেন, ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে কি-না, তা নির্ভর করছে সংস্কার কতটুকু সম্পন্ন হয়, এর ওপর। ডিসেম্বরে নির্বাচন দেওয়া নিয়ে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলই বলছে, কিন্তু সব দল নয়। ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন করতে সরকার বদ্ধ পরিকর। ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে গেলে তাড়াহুড়ো করে সংস্কার করতে হবে। ভালো করে সংস্কারের জন্য ডিসেম্বরের পর আরও ৬ মাস প্রয়োজন। নির্বাচিত দলের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চাই। অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা এ সরকারের মূল লক্ষ্য দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা। 

‘উত্তাল বিশ্বে এশিয়ার চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক বক্তব্যে অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, সমাজের অভ্যন্তরে, এমনকি নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্ব ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, আমরা এক গভীর অনিশ্চিত সময় পার করছি। আমরা এমন একটি বিশ্বকে প্রত্যক্ষ করছি যেখানে শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে, উত্তেজনা বাড়ছে এবং পারস্পরিক সহযোগিতা সবসময় নিশ্চিত থাকছে না। এশিয়া ও তার বাইরের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে এবং শান্তি দিন দিন অধরা হয়ে উঠছে। ইউক্রেন, গাজা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যুদ্ধ ও মানবসৃষ্ট সংঘাত হাজারো মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস করে দিচ্ছে। 

তিনি বলেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ এক নির্মম রূপ নিয়েছে এবং সাম্প্রতিক ভূমিকম্প এর গভীর মানবিক সংকটকে আরও অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সম্প্রতি আমাদের দুই প্রতিবেশীর মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু ব্যয়বহুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। অত্যন্ত দুঃখজনক যে আমরা কোটি কোটি টাকা যুদ্ধের পেছনে ব্যয় করছি, অথচ লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে বা ন্যূনতম চাহিদার জন্য লড়াই করছে।’ তিনি যুদ্ধবিরতির জন্য উভয় দেশের নেতাদের ধন্যবাদ জানান এবং দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সহাবস্থানের আশাবাদ ব্যক্ত করেন। 

তিনি বলেন, বাণিজ্যিক বিধিনিষেধ বেড়ে যাওয়ায় মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থার ভিত্তি চ্যালেঞ্জের মুখে এবং আর্থিক বৈষম্য সমাজে বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ায় এমন বিভাজনের কারণে অসন্তোষ ও অস্থিরতা দেখা গেছে, যা শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ডেকে এনেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বহুমুখী অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখছে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এবং মানবিক কারণে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে।

ড. ইউনূস বলেন, ‘বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষের আবাসস্থল এশিয়া অনিশ্চয়তার কেন্দ্রস্থলে, একই সঙ্গে সম্ভাবনারও কেন্দ্রে। আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো বিশাল, কিন্তু আমাদের সম্মিলিত শক্তিও বিশাল। এ বাস্তবতায়, আমি বিশ্বাস করি এশিয়ার সামনে একটি সুযোগ, এমনকি একটি দায়িত্ব রয়েছে ভিন্ন পথ দেখানোর : শান্তির, সংলাপের, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের। শুধু সংখ্যাগত নয়, মানুষের কল্যাণ, আস্থা ও আশার উন্নয়ন।’ 

তিনি বলেন, এশিয়ার ভবিষ্যৎ কেবল অর্থনীতি বা ভূরাজনীতির বিষয় নয়, এটি মানুষের, ভাবনার এবং সাহসের বিষয়। ভয়ের দ্বারা নয়, সম্ভাবনার দ্বারা; শক্তির দ্বারা নয়, উদ্দেশ্যের দ্বারা পরিচালিত হই। চলুন, একটি উত্তম বিশ্বের কল্পনা করতে সাহসী হই। চলুন, একে অপরের প্রতি আস্থা রাখি। চলুন, শুধু প্রয়োজনীয়তার কারণে নয়, বরং আন্তরিক ইচ্ছে থেকে একে অপরকে সহযোগিতা করি। এশিয়ার ভবিষ্যৎ এখনো লেখা হয়নি-আমরাই তা একসঙ্গে লিখব। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ও জাপান একসঙ্গে কাজ করে এশিয়ার ভাগ্য এমনকি বিশ্বের ভাগ্যও পুনর্লিখন করতে পারে।

বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ শ্রমিক নেবে জাপান : ক্রমবর্ধমান শ্রমিক সংকট মোকাবিলায় আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে অন্তত এক লাখ শ্রমিক নিয়োগের কথা জানিয়েছে জাপানি কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীরা। বৃহস্পতিবার টোকিওতে ‘বাংলাদেশ সেমিনার অন হিউম্যান রিসোর্সেস’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘জাপানে বাংলাদেশিদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার প্রয়োজনীয় সব কিছু করবে।’ তিনি বলেন, ‘এটি শুধু কাজ করার জন্য নয়, বরং জাপানকে জানারও দ্বার উন্মোচন করবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য।’

সেমিনারে প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়। প্রথমটি বাংলাদেশের ব্যুারো অব ম্যানপাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিএমইটি) ও কাইকম ড্রিম স্ট্রিট (কেডিএস)-এর মধ্যে, দ্বিতীয়টি বিএমইটি ও জাপানের ন্যাশনাল বিজনেস সাপোর্ট কম্বাইন্ড কো-অপারেটিভস (জাপানে ৬৫টির বেশি কোম্পানির একটি ফেডারেশন) এবং জেবিবিআরএ (জাপান বাংলা ব্রিজ রিক্রুটিং এজেন্সি)-র মধ্যে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এই অনুষ্ঠানটি একটি দ্বার উন্মোচনের প্রতীক। বাংলাদেশ ১৮ কোটি মানুষের দেশ, যার অর্ধেকই ২৭ বছরের নিচে। সরকারের কাজ হলো তাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া।’

শিজুওকার কর্মপরিবেশ উন্নয়ন সমবায়ের তত্ত্বাবধায়ক সংস্থার প্রতিনিধি পরিচালক মিতসুরু মাতসুশিতা বলেন, ‘অনেক জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশিদের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছে এবং তিনি বিশ্বাস করেন যে এই ধারা অব্যাহত থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশি মেধাবীদের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের প্রতিভা লালন করা আমাদের দায়িত্ব।’

এনবিসিসি চেয়ারম্যান মিকিও কেসাগায়ামা বলেন, প্রায় ১৪ বছর আগে অধ্যাপক ইউনূস জাপানে এসেছিলেন এবং ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে নারীদের সহায়তার গল্প বলেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের ফেডারেশন তরুণ ও দক্ষ শ্রমিকের জন্য বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনাময় উৎস হিসেবে দেখছে। তারা উভয় দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে। আগামী পাঁচ বছরে আমরা এক লাখ বাংলাদেশি শ্রমিককে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।’ 

জাপানের স্বাস্থ্য, শ্রম ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের (এমএইচএলডব্লিউ) প্রতিমন্ত্রী নিকি হিরোবুমি বলেন, ‘জাপানে জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে এবং সে কারণে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সহায়তা প্রয়োজন হবে। এটি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, জাপানের জন্যও একটি আশাব্যঞ্জক দিক হতে পারে।’

  • Related Posts

    এবারও নৌপথে ঘরে ফেরা মানুষের কোনো সমস্যা হবে না: উপদেষ্টা

    গত রোজার ঈদে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপে কারণে নৌপথে ঘরে ফেরা মানুষের কোনো সমস্যা হয়নি, এবারের ঈদেও কোনো সমস্যা হবে না বলে জানিয়েছেন নৌ-পরিবহণ এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার…

    Continue reading
    কমলো ডিজেল-অকটেন-পেট্রোলের দাম, বেড়েছে কেরোসিনের

    দেশের বাজারে ফের কমেছে জ্বালানি তেলের দাম। প্রতি লিটার ডিজেলের দাম লিটারে ২ টাকা এবং পেট্রোল ও অকটেনের দাম লিটারে ৩ টাকা কমানো হয়েছে। নতুন এ দাম রোববার দিনগত মধ্যরাত…

    Continue reading

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    এবারও নৌপথে ঘরে ফেরা মানুষের কোনো সমস্যা হবে না: উপদেষ্টা

    এবারও নৌপথে ঘরে ফেরা মানুষের কোনো সমস্যা হবে না: উপদেষ্টা

    কমলো ডিজেল-অকটেন-পেট্রোলের দাম, বেড়েছে কেরোসিনের

    কমলো ডিজেল-অকটেন-পেট্রোলের দাম, বেড়েছে কেরোসিনের

    ট্রাম্প প্রশাসন থেকে ইলন মাস্কের বিদায়: অটুট বন্ধুত্বে নীতি নিয়ে মতভেদ

    ট্রাম্প প্রশাসন থেকে ইলন মাস্কের বিদায়: অটুট বন্ধুত্বে নীতি নিয়ে মতভেদ

    পশ্চিমবঙ্গে ফুঁসছে তিস্তা, প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশেও

    পশ্চিমবঙ্গে ফুঁসছে তিস্তা, প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশেও

    পাঁচ জেলায় বজ্রপাতে প্রাণ গেলো ৮ জনের

    পাঁচ জেলায় বজ্রপাতে প্রাণ গেলো ৮ জনের

    মেঘনায় ট্রলারডুবিতে ১ জনের প্রাণহানি, নিখোঁজ ৭

    মেঘনায় ট্রলারডুবিতে ১ জনের প্রাণহানি, নিখোঁজ ৭

    ইন্দোনেশিয়াকে রুখে দিলো বাংলাদেশ

    ইন্দোনেশিয়াকে রুখে দিলো বাংলাদেশ

    দুর্নীতি নয়, ব্যর্থতার দায়ে ফারুককে অপসারণ: ক্রীড়া উপদেষ্টা

    দুর্নীতি নয়, ব্যর্থতার দায়ে ফারুককে অপসারণ: ক্রীড়া উপদেষ্টা

    ঈদে কেমন যাবে ইয়াশ-তিশার ‘কিসমত’

    ঈদে কেমন যাবে ইয়াশ-তিশার ‘কিসমত’

    পারিবারিক গল্পে মুগ্ধ করবে জাহিদ-জয়া-চঞ্চলের সিনেমা

    পারিবারিক গল্পে মুগ্ধ করবে জাহিদ-জয়া-চঞ্চলের সিনেমা