
আজ ৬০–এ পা দিলেন আমির খান। ৮ বছর ৮ মাস বয়সে ‘ইয়াদোঁ কী বারাত’ ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান এই বলিউড সুপারস্টার। আর ২৩ বছর বয়সে ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’–এ নায়ক। আমিরের চলচ্চিত্র ভ্রমণ আজও চলমান।
সব সময় আমার লক্ষ্য ছিল দর্শকদের হৃদয় জয় করা। কিন্তু নিজের পরিবারকে আমি নিজের অজান্তেই দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম। ওই সময়ে আইরার (মেয়ে) আমাকে প্রয়োজন ছিল। জুনাইদ (ছেলে) আমাকে ছাড়া বড় হয়ে উঠেছে। সিনেমার জগতে আমি এক পরিবার গড়ে তুলেছিলাম। সেই পরিবারের সবার চাহিদা, সুখ-দুঃখের কথা জানতাম। কিন্তু নিজের পরিবারের মানুষদের মনের খবর আমি তখন রাখিনি।
আমির খান
রোমান্টিক ছবি দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করে খ্যাতির মধ্যগগনে থাকা অবস্থায় ভিন্ন পথে হাঁটতে শুরু করেন আমির খান। ‘লগান’, ‘দিল চাহতা হ্যায়’, ‘দঙ্গল’, ‘পিকে’, ‘সিক্রেট সুপারস্টার’-এর মতো ব্যতিক্রমী ছবি দিয়ে বিটাউনের তথাকথিত সুপারস্টারদের থেকে নিজের ফারাকটা তুলে ধরেন। ছবি নির্বাচনের ক্ষেত্রে খুবই খুঁতখুঁতে তিনি। শুধু তা–ই নয়, ছবির কোনো দৃশ্য মনের মতো না হওয়া পর্যন্ত হাল ছাড়েন না। এ জন্য আমিরের নামের আগে জুড়ে গেছে ‘মিস্টার পারফেকশনিস্ট’ তকমা।
সম্প্রতি মুম্বাইয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আমির বলেছিলেন, ‘আমি শুধু অভিনেতাদের নয়, পরিচালকেরও অডিশন নিই।’
নিজেকে কখনো ‘পারফেক্ট’ মনে করেন না। তাঁর ভাষ্যে, ‘আমি পরিপূর্ণতায় বিশ্বাসী নই। আর আমি জীবনে সমতা বজায় রেখে চলতে পারিনি। জীবনের অনেক জায়গায় আমি ইমপারফেক্ট।’ আবেগপ্রবণ হয়ে আরও বললেন, ‘সব সময় আমার লক্ষ্য ছিল দর্শকদের হৃদয় জয় করা। কিন্তু নিজের পরিবারকে আমি নিজের অজান্তেই দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম। ওই সময়ে আইরার (মেয়ে) আমাকে প্রয়োজন ছিল। জুনাইদ (ছেলে) আমাকে ছাড়া বড় হয়ে উঠেছে। সিনেমার জগতে আমি এক পরিবার গড়ে তুলেছিলাম। সেই পরিবারের সবার চাহিদা, সুখ-দুঃখের কথা জানতাম। কিন্তু নিজের পরিবারের মানুষদের মনের খবর আমি তখন রাখিনি।’

আমির জানিয়েছেন, বছর চারেক আগে তিনি অভিনয়জীবন থেকে অবসর নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। তাঁর এই সিদ্ধান্তে চমকে উঠেছিলেন ছেলে জুনাইদ, মেয়ে আইরা আর সাবেক স্ত্রী কিরণ। সে সময়ের কথা তুলে আমির বললেন, ‘জুনাইদ আর আইরা আমাকে বলে যে ৩০ বছর ধরে আমি পাগলের মতো শুধু এটাই করে আসছি। আমি কী করে সিনেমা থেকে বিদায় নিতে পারি। আর কিরণ বলেছিল যে আমি সিনেমার সন্তান। সিনেমার জন্যই আমার জন্ম। তাই আমি কখনোই অভিনয় ছাড়তে পারি না। এখন আপনারাই বলেন আমি কী করব?’
দর্শকের হৃদয় জয় করা আমিরের লক্ষ্য হলেও ছবি নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমির নিজের কথা ভাবেন। ‘ছবি নির্বাচনের সময় আমি দর্শকের কথা ভাবি না। ভাবি না তাঁদের প্রতিক্রিয়া কী হবে। আমি শুধু দেখি যে ছবির চিত্রনাট্য আমার মনের মতো কি না।’

তবে ছবি মুক্তির আগে ভীষণ চাপে থাকেন এই অভিনেতা। হেসে বললেন, ‘কোনো ছবি রিলিজের আগে আমি ভাবি যে ছবিটা তো করে ফেললাম, এবার দর্শকের প্রতিক্রিয়া কী রকম হবে।’ প্রসঙ্গক্রমে ব্যর্থ সিনেমার কথাও এসেছে। ‘থাগস অব হিন্দুস্তান’ মুক্তির আগেই বুঝে গিয়েছিলেন ছবিটা চলবে না। এই ছবির ব্যর্থতা হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু স্বপ্নের ছবি ‘লাল সিং চাড্ডা’র ব্যর্থতা আমির মেনে নিতে পারেননি। আজও এই ছবির ব্যর্থতা কষ্ট দেয় তাঁকে। এখনো লাল সিং চাড্ডা নিয়ে কাটাছেঁড়া করতেই থাকেন তিনি, কেন ব্যর্থ হলো। ‘লাল সিং চাড্ডা’র ব্যর্থতার কারণে মানসিক অবসাদ এতটাই ছিল যে আমিরকে থেরাপি নিতে হয়েছিল।
রোমান্টিক ছবির ভক্ত আমির। তাঁর কথায়, ‘প্রায় সব রোমান্টিক ছবি আমার প্রিয়। আমি রোমান্টিক ছবির মধ্যে হারিয়ে যাই। আর মানুষ হিসেবেও আমি খুব রোমান্টিক।’
তাঁর রোমান্টিক ছবি ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ ব্লকবাস্টার হয়েছিল। তবে এরপর তাঁর অভিনীত একাধিক রোমান্টিক ছবি বক্স অফিসে চূড়ান্ত ব্যর্থ। এ নিয়েও কিছু কথা বলেছেন, ‘“কেয়ামত সে কেয়ামত তক”-এর পর আমার কাছে ৩০০-৪০০ ছবির প্রস্তাব এসেছিল। তখন প্রায় সব অভিনেতা একসঙ্গে ৩০-৫০টা ছবি করতেন। ওনাদের দেখে আমিও ৯-১০টা ছবিতে একসঙ্গে সাইন করেছিলাম। কিন্তু শুটিং শুরু হওয়ার পর ভুল বুঝতে পারি। সারা দিন ছোটাছুটি করতাম। তিন শিফটে কাজ। দিন শেষে শরীরজুড়ে শুধুই ক্লান্তি। কখনোই নিজের শতভাগ দিতে পারতাম না। কোনোমতে ছবিগুলোর শুটিং শেষ করেছিলাম। কিন্তু আমার সব ছবি একের পর এক ফ্লপ হতে শুরু করে। “লাভ লাভ”, “তুম মেরে হো”সহ ওই সময়ের সব ছবি ফ্লপ করেছিল। আমি তখন কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ঘরে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাঁদতাম। আমাকে “ওয়ান ফিল্ম ওয়ানডার” তকমা পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল। একসময় পর বুঝতে পারি যে ভালো চিত্রনাট্য হলেই হবে না, পরিচালক-প্রযোজকের দৃঢ়বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন।’
আমিরের সঙ্গে নানা সময় কথা বলে, আড্ডা দিয়ে বুঝেছি পর্দার বাইরে মানুষটা সাদামাটা, সহজ সরল। তারকাসুলভ আচরণের থেকে একদম দূরে। অবসরে সিনেমা দেখার চেয়ে বই পড়তে বেশি ভালোবাসেন আমির। জন্মদিনে বই পেলে খুব খুশি হন।

বাচ্চারা যেমন পছন্দের চকলেট বক্স পেলে খুশি হয়, ঠিক তেমন। বারবার ধন্যবাদ দিতে থাকেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে সিনেমা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারতে ভালোবাসেন। মেয়ে আইরার বিয়ের রিসেপশন হোক বা তাঁর জন্মদিন, সাংবাদিকদের সামনে গল্পের ঝুলি খুলে বসে পড়েন এই সুপারস্টার। আর সেই ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসে সিনেমার নানান অজানা কথা। তবে বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করেন এসব ছাপা যাবে না, শর্ত নয়; আবেদন। তাই আমিরের সঙ্গে আড্ডার সব রসদ শুধুই স্মৃতির মণিকোঠায় থেকে যায়।
আজ ১৪ মার্চ আমিরের ৬০তম জন্মদিন উপলক্ষে চলচ্চিত্র পরিবেশক, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান পিভিআর সিনেমা আমির খান: সিনেমা কা জাদুকর শীর্ষক এক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করেছে।

২৭ মার্চ পর্যন্ত সারা ভারতে প্রদর্শিত হবে আমির অভিনীত ‘আন্দাজ আপনা আপনা’, ‘হাম হ্যায় রাহি প্যায়ার কে’, ‘রং দে বাসন্তী’,‘ লগান’, ‘দঙ্গল’, ‘থ্রি ইডিয়েটস’সহ জনপ্রিয় সব ছবি। সিনেমার এই জাদুকরের আরও জাদুকরি আখ্যানের অপেক্ষায় থাকবেন আপামর ভক্তরা। শুভ জন্মদিন, আমির খান।