লোডশেডিংয়ে হাঁসফাঁস উত্তরাঞ্চলের মানুষ

বগুড়াসহ সমগ্র উত্তরাঞ্চলে তীব্র আকার ধারণ করেছে লোডশেডিং। দিনে-রাতে কোনো সময়ই নির্বিঘ্নে বিদ্যুৎ সরবরাহ মিলছে না। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন এই অঞ্চলের কোটি কোটি গ্রাহক। ক্ষতি হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তরের ১৬ জেলায় নেসকো ও পল্লী বিদ্যুতের চাহিদা দুই হাজার ৬০০ থেকে দুই হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। সরবরাহ মিলছে এক হাজার ৭০০ থেকে এক হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। ঘাটতি থাকছে ৯০০ মেগাওয়াটেরও বেশি। এরমধ্যে রংপুর বিভাগের আট জেলায় পল্লী বিদ্যুৎ ও নেসকোর কাছে চাহিদা এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট। সেখানে মিলছে ৮০০ মেগাওয়াটেরও কম। ঘাটতি ৪০০ মেগাওয়াটের ওপরে। তবে জেলা শহরের বাইরে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিদ্যুৎ একেবারে থাকছে না বললেই চলে।

সীমান্ত জেলা কুড়িগ্রামে এক ঘণ্টা পরপর লোডশেডিং হচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকায় এটিএম বুথ, স্টুডিও, ওয়েলডিং কারখানাসহ ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। একইসঙ্গে কয়েক সপ্তাহ ধরে অনাবৃষ্টিতে আমন ক্ষেতে সেচ দিতে হচ্ছে কৃষকদের। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভ্রাটে সেচ ব্যবস্থা হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। সেচ প্রকল্পের বেশিরভাগ গ্রাহক পল্লী বিদ্যুতের আওতাভুক্ত হওয়ায় লোডশেডিংয়ের প্রভাব পড়ছে।

শহরের ঘোষপাড়ার চাকরিজীবী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘দুপুর ১২টা বাজে এটিএম বুথে এসেছি। পৌনে ১টার দিকে কারেন্ট (বিদ্যুৎ) এলো, এখনো বুথের মেশিন চালু হয়নি। মেশিন চালু হতে আধাঘণ্টা সময় নেবে। আমার এখানে বাড়তি দেড় ঘণ্টা সময় অপচয় হলো।’

নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) কুড়িগ্রাম কার্যালয়ের উপ-সহকারী প্রকোশলী জীবন চন্দ্র রায় বলেন, সোমবার বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৬৮ মেগাওয়াট। আমরা বরাদ্দ পেয়েছি ৩৮ মেগাওয়াট। ঘাটতি পূরণে এক ঘণ্টা পরপর জেলার আটটি ফিডে লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে।

বগুড়া শহরের রাজাবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক পরিমল প্রসাদ রাজ বলেন, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে ঠিকমতো বেচাবিক্রি করা যাচ্ছে না। এতে বড় আর্থিক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।

নেসকো বগুড়া সূত্রে জানা যায়, গ্রাহকসেবার সুবিধার্থে বগুড়া শহরকে বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-১, ২, ৩ ও ৪ অঞ্চলে ভাগ করে বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। শহর ছাড়াও দুপচাঁচিয়া, শেরপুর ও শিবগঞ্জ উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে নেসকো। এই চার অঞ্চলে গড়ে মোট বিদ্যুতের চাহিদা ১০৫ মেগাওয়াট। বিপরীতে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ মিলছে ৫০-৬০ মেগাওয়াট।

একইভাবে রংপুরের শঠিবাড়ি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় ছয় লাখের ওপর গ্রাহক রয়েছেন। দৈনিক চাহিদা ১২০-১৩০ মেগাওয়াট। সেখানে বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে ৬৫-৭০ মেগাওয়াট। ঘাটতি থাকছে ৫০-৬০ মেগাওয়াট।

নীলফামারীতে লোডশেডিংয়ে ব্যাহত হচ্ছে শিল্পকারখানার উৎপাদন। বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল ছোট ছোট উদ্যোক্তারা পড়েছেন মারাত্মক ক্ষতির মুখে। শুধু তাই নয়, লো-ভোল্টেজে ঝুঁকি নিয়ে মিল-কারখানা চালাতে গিয়ে বৈদ্যুতিক মোটরসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে।

নেসকো বলছে, কোনো এলাকায়ই চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ঘাটতির পরিমাণ অনেক। এ কারণে বাধ্য হয়ে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়তে হচ্ছে গ্রাহকদের।

ইকু জুট মিল প্রসেস নামের পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিদ্দিকুল আলমের কারখানাটির অবস্থান নীলফামারীর ঢেলাপীড়ের কাদিখোল এলাকায়। সেখানে পাটের ব্যাগ ও সুতা উৎপাদন হয়। এসব পণ্য রপ্তানি হয় ভারত, নেপাল, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশে। প্রায় দেড় মাস ধরে লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন অর্ধেকের কমে গেছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে লোকসান গুনতে হচ্ছে এ শিল্প উদ্যোক্তাকে।

সিদ্দিকুল আলম বলেন, ‘ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে মূল্যবান যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। দীর্ঘসময় বিদ্যুৎ না থাকায় শ্রমিকরাও কাজ করতে চান না। কারণ তারা কাজের ওপর টাকা পান। ফলে বাধ্য হয়েই তারা রাজমিস্ত্রি, ইটভাটা, কৃষিসহ বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হচ্ছেন।

বণিক সমিতির সভাপতি ইদ্রিস আলী বলেন, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ননির্ভর করে উৎপাদনমুখী শিল্পে। এ শিল্প বাঁচাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা না গেলে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়া যাবে না।

এ বিষয়ে নেসকোর নির্বাহী প্রকৌশলী আলিমুল ইসলাম সেলিম জানান, চাহিদা অন্তত ১৬ মেগাওয়াট। সেখানে সরবরাহ মিলছে ১০-১২ মেগাওয়াট। এ কারণে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।

গাইবান্ধায় লোডশেডিংয়ের কারণে বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীসহ বিপদে পড়েছেন আবাসিক এলাকার বাসিন্দারাও। লেখাপড়াসহ গৃহস্থালি কাজে ব্যাঘাত ঘটায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে। দিনের তুলনায় রাতে লোডশেডিং বেশি হচ্ছে।

পৌর এলাকার গৃহিণী সিদ্দিকা কামাল নাজু বলেন, লোডশেডিংয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছে। গরমে রাতে ঘুমাতে পারি না।

শহরের ব্রিজরোড এলাকার ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ী তৈয়ব মিয়া বলেন, বিদ্যুতের ওপরই মূলত আমাদের ব্যবসা। বিদ্যুৎ ঠিকমতো না পাওয়ায় আমাদের অনেক কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। ঠিকমতো পণ্য ডেলিভারি দিতে পারছি না।

নেসকো গাইবান্ধার নির্বাহী প্রকৌশলী ফজলুর রহমান বলেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম পাচ্ছি। এ কারণে ঘাটতি পূরণে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।

  • Related Posts

    স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মালয়েশিয়ায় কূটনীতিকদের সংবর্ধনা

    যথাযোগ্য মর্যাদা এবং উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ৫৪তম বার্ষিকী এবং জাতীয় দিবস উদযাপন করেছে কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন। বুধবার (১৬ এপ্রিল) কুয়ালালামপুরের একটি পাঁচতারকা হোটেলে আয়োজিত কূটনৈতিক সংবর্ধনায় উপস্থিত ছিলেন…

    Continue reading
    নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ

    নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশ এখনই বাস্তবায়নযোগ‍্য- তা দ্রুত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন,…

    Continue reading

    স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মালয়েশিয়ায় কূটনীতিকদের সংবর্ধনা

    স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মালয়েশিয়ায় কূটনীতিকদের সংবর্ধনা

    নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ

    নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ

    কঙ্গোতে নৌ দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৪৮, নিখোঁজ শতাধিক

    কঙ্গোতে নৌ দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৪৮, নিখোঁজ শতাধিক

    কুমিল্লায় বাসচাপায় প্রাণ গেল পথচারীর

    কুমিল্লায় বাসচাপায় প্রাণ গেল পথচারীর

    শিরোপা লড়াইয়ে আরও পিছিয়ে রোনালদোর আল নাসর

    শিরোপা লড়াইয়ে আরও পিছিয়ে রোনালদোর আল নাসর

    দুই বাংলার জনপ্রিয় নির্মাতা সৃজিত মুখার্জি আইসিইউতে

    দুই বাংলার জনপ্রিয় নির্মাতা সৃজিত মুখার্জি আইসিইউতে

    মালয়েশিয়ায় অভিজাত রেস্তোরাঁয় অভিযান, ১০ বাংলাদেশিসহ আটক ৪৫ অভিবাসী

    মালয়েশিয়ায় অভিজাত রেস্তোরাঁয় অভিযান, ১০ বাংলাদেশিসহ আটক ৪৫ অভিবাসী

    রেললাইনে বাস, কয়েক সেকেন্ডের জন্য রক্ষা পেলেন অর্ধশতাধিক যাত্রী

    রেললাইনে বাস, কয়েক সেকেন্ডের জন্য রক্ষা পেলেন অর্ধশতাধিক যাত্রী

    গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত আরও ৭০ ফিলিস্তিনি

    গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত আরও ৭০ ফিলিস্তিনি

    দুপুরের মধ্যে যেসব জেলার ওপর ঝড়ের শঙ্কা

    দুপুরের মধ্যে যেসব জেলার ওপর ঝড়ের শঙ্কা