
বাংলা বছর ১৪৩১ বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করে নিতে বড় আয়োজন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সে প্রস্তুতি প্রসঙ্গে সবাইকে জানাতে আজ (৯ এপ্রিল) বুধবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সেখানে চৈত্রসংক্রান্তি ও বর্ষবরণ আয়োজনের বিস্তারিত তুলে ধরেন সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা চলচ্চিত্রকার মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমি মিলনায়তনে এ সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি। সংবাদ সম্মেলনে ফারুকীর বক্তব্য ও উৎসবের বিস্তারিত পাঠকের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো।
সবাইকে নিয়ে উৎসব
আমরা অল ইনক্লুসিভ একটা চৈত্র সংক্রান্তি ও নতুন বছর উদযাপন করতে যাচ্ছি। সকল জাতিগোষ্ঠী এটাকে সাদরে গ্রহণ করছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতায় অনেক অনুষ্ঠান হচ্ছে বা বেসরকারি উদ্যোগেও হচ্ছে। কিন্তু ফ্ল্যাগশিপ অনুষ্ঠান বলতে যা বোঝায় সেটা হতে যাচ্ছে এবার।
এই আয়োজনের দর্শন
আমাদের কালচারাল ফিলসফি কী, কেন আমরা এটা করছি? আমাদের সরকারের সব কাজের পেছনে দুটো ব্যাপার কাজ করে। একটা হচ্ছে কালচারাল হিলিং (সাংস্কৃতিকক্ষত পূরণ), আরেকটা হচ্ছে কালচারাল ইনক্লুসিভনেস (সাংস্কৃতিকভাবে অন্তর্ভুক্তি)। আমরা দীর্ঘদিন বিভাজনের মধ্যে ছিলাম। একটা গোষ্ঠীর সঙ্গে আরেকটি গোষ্ঠীর দূরত্ব, সংশয়, অবিশ্বাস ছিল। সেটা থেকে হিলিংয়ের একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথমবার শিল্পকলা একাডেমি চাঁদরাতে অনুষ্ঠান করেছে। সামনে সারা দেশে হবে। শুধু মুসলমানদের উৎসব ঘিরে নয়, অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবগুলোও সারা দেশব্যাপী হবে।
সবাইকে নিয়ে নতুন বছর উদযাপন যে কারণে
সকল জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে একত্রে উৎসব করার চেষ্টা করছি। এর মূল কারণ কালচারাল ইনক্লুসিভনেস। আমাদের শক্তি ও সৌন্দর্য হচ্ছে বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্যকে আমরা সেলিব্রেট করতে চাই। আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উৎসবগুলো চৈত্রসংক্রান্তি ঘিরে হয়। আমাদের উৎসবটাও তাই এবার চৈত্রসংক্রান্তি থেকে শুরু হচ্ছে।
কী কী থাকছে চৈত্রসংক্রান্তি উদযাপনে
চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে ১৩ এপ্রিল শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে দেশের ১২ জেলায় সাধুমেলা হচ্ছে। জেলাগুলো হলো চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, বরিশার, সিলেট, ঢাকা, মাগুরা, কুমিল্লা, কুড়িগ্রাম ও বগুড়া। সেখানে সাধুসঙ্গ ও আধ্যাত্মিক গানের অনুষ্ঠান হবে। অনুষ্ঠান শুরু হবে সন্ধ্যা ৬টায়। এ দিন শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজারে বসবে ফাগুয়া উৎসব।
চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রয়েছে কনসার্ট। বিকাল ৩টা থেকে সেখানে গান গাইবে গারো সম্প্রদায়ের ব্যান্ড এফ মাইনর, মারমা সম্প্রদায়ের লা রং, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ইমাং, খাসিয়া সম্প্রদায়ের ইউনিটি, চাকমা সম্প্রদায়ের ইনভোকেশন, বাঙালির মাইলস, ওয়ারফেজ, ভাইকিংস, অ্যাভয়েড রাফা, দলছুট, স্টোনফ্রি।
শিল্পকলা একাডেমিতে ১৩ ও ১৪ এপ্রিল রয়েছে দিনব্যাপী ধামাইল নৃত্য, গান, ভিডিও প্রদর্শনী, সন্ধ্যায় বাউল গান, সেমিনার।
কী কী থাকছে পয়লা বৈশাখ উদযাপনে
নববর্ষে ছায়ানটের অনুষ্ঠান হচ্ছে, সুরের ধারার অনুষ্ঠানও হচ্ছে, যদিও তাতে একটু পরিবর্তন এসেছে। আগে তাদের অনুষ্ঠান হতো চীন-মৈত্রী সম্মেলনকেন্দ্রে বা লালমাটিয়া কলেজে। এবার হবে রবীন্দ্রসরোবরে। এতে এটা ধানমন্ডির নেইবারিং উৎসব হয়ে উঠবে। সরকারের ইনক্লুসিভ নীতিকে সমর্থণ জানিয়ে সুরের ধারা এবার অন্য জাতিগোষ্ঠীকের সংস্কৃতিকেও যুক্ত করছে। তাই এবার শুধু বাংলা নয়, অন্য গোষ্ঠীর গানও করবে তারা।
বড় আয়োজন বৈশাখী শোভাযাত্রা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে সকালে থাকবে বৈশাখী শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রার কোনো নাম এখনও ঠিক করা হয়নি। এতে এবার বাঙালিসহ ২৭টি নৃগোষ্ঠী অংশ নেবে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই, পাংখোয়া, বম, ম্রো, চাক, খিয়াং, খুমি, সাঁওতাল, ওঁরাও, গড়াৎ, মাহালী, মালপাহাড়িয়া, কোল, মাহাতো, মুণ্ডা, বাজোয়াড়, মনিপুরী, খাসিয়া, চা-জনগোষ্ঠী, গারো, হাজং, কোচ, রাখাইন। তারা নিজের সংস্কৃতি, পোশাক, বাদ্যযন্ত্র নিয়ে হাজির হবেন। তাদের অনেকে আধুনিক যন্ত্র বাজায়। মারমাদের একটা গিটার স্কুল আছে, তারা ১৫-২০ জন তরুণ গিটার প্লেয়ার নিয়ে আসছে।। ম্রো বাঁশি বাদক নিয়ে আসছে।

শোভাযাত্রায় রক শিল্পীরা
চারুকলার শোভাযাত্রায় প্রথমবারের মতো যোগ দিচ্ছে রক শিল্পীদের সংগঠন বামবা। প্যালেস্টাইনে একটা বড় গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। আমরা আহ্বান জানিয়েছি, ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে যত গিটার প্লেয়ার আছেন, তারা যেন গিটার ও প্যালেস্টাইনের পতাকা নিয়ে এই শোভাযাত্রায় যোগ দেন। এ সময় সবাই একত্রে গাইবে ‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি, প্যালেস্টাইন উইল বি ফ্রি’।
মানিকমিয়ায় কনসার্ট ও ড্রোন শো
রাজধানীর মানিকমিয়া অ্যাভিনিউতে বিকেল ৩টায় থাকবে কনসার্ট। শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে এতে সহযোগিতা করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। কনসার্টের পর সন্ধ্যা ৭টায় থাকবে একটা ড্রোন শো। চীনা দূতাবাসের সহযোগিতায় এটা বাংলাদেশে খুব এক্সক্লুসিভ একটা জিনিস হতে যাচ্ছে। এর থিম হচ্ছে – নতুন বছর, নতুন বাংলাদেশ। সেখানে জুলাইকে দেখা যাবে, নববর্ষকে দেখা যাবে। সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ২ হাজার ৬০০ ড্রোন উড়বে।
বাংলা একাডেমিতে বৈশাখী মেলা
বিসিকের আয়োজনে পয়লা বৈশাখ থেকে সাত দিন বাংলা একাডেমি চলবে বৈশাখী মেলা।
এছাড়া ৩০ জেলায় বৈশাখী লোকনাট্য উৎসব, ১২ জেলায় অ্যাক্রোবেটিক শো, ১৫ দিনব্যাপী মেলা করছে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। পাহাড়ে ও সমতলে অনেকগুলো নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক সেল মেলা ও সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে।
১৫ এপ্রিল বিকেল ৩টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় রয়েছে ব্যান্ডশিল্পীদের পরিবেশনা ও নৃত্য। পরিবেশন করবে বাংলা ফাইভ, রে রে, অনিমেষ, সর্বনাম। একক কণ্ঠে গান শোনাবেন ফেরদৌস আরা।
পরিশেষে
আমাদের মনে রাখতে হবে নিজের উৎসব আনন্দের দিনে আমরা যেন নিপীড়িত মানুষের কথা ভুলে না যাই। সে কারণে আমরা ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষকেও স্মরণ করবো।
ঢাকার বাইরের আরও আয়োজন
১৩ থেকে ১৯ এপ্রিল বিকেল ৩টা থেকে বিভিন্ন জেলার স্থানীয় পালাগান, কবিগান, পুথিপাঠ, জারিগান, পুতুলনাচ, লাঠিখেলা, ঢাকিনৃত্য ও লোকনাট্য উৎসব।
১৫ থেকে ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭টা থেকে অ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শনী সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, নোয়াখালী, ফেনী, হাতিয়া ও লক্ষীপুরে।
১৪ থেকে ২৮ এপ্রিল সোনারগাঁওয়ের বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ১৫ দিনের বৈশাখী মেলা।
১৩ এপ্রিল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি বিরিশিরিতে লোক মেলা।
৪ থেকে ৭ এপ্রিল খাগড়াছড়ি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটে বৈসু, সংগ্রাইং, বিজু, বিষু, বিহু, সাংলান ও বাংলা নববর্ষ-১৪৩২।
১৭ থেকে ১৯ এপ্রিল কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে চৈত্রসংক্রান্তি / সাংগ্রাই বিজু অনুষ্ঠান।
১৪ এপ্রিল রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটে বিজু সাংগ্রাই বৈসুক বিষু বিহু মেলা ২০২৫, শোভাযাত্রা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
১৪ এপ্রিল রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমিতে শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, পুরস্কার বিতরণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
২৫ বা ২৬ এপ্রিল নওগাঁর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে সারহুল উৎসব।
১২, ১৩, ১৫, ১৭ ও ১৮ এপ্রিল বান্দরবানের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটে সাংগ্রাই, বিজু ও বৈসু উপলক্ষে অনুষ্ঠান।
১৪ থেকে ১৮ এপ্রিল মণিপুরী ললিতকলা একাডেমি প্রাঙ্গনে মেলা, ঐতিহ্যবাহী নিকন খেলা ও স্বকীয় পোষাক প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক আয়োজন।