শারদীয় দুর্গাপূজার চার দিনের ছুটিকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের ঢলে প্রাণ ফিরে পেয়েছে দেশের পর্যটন রাজধানী কক্সবাজার। শরতের মিষ্টি রোদ, সাদা মেঘের ভেলা এবং হঠাৎ বৃষ্টি সৈকত নগরীর প্রকৃতিকে আরও মোহনীয় করে তুলেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা ভ্রমণপ্রেমীরা কক্সবাজারের দীর্ঘ সৈকতের শীতল বাতাসে প্রাণ জুড়াচ্ছেন। ছুটির মৌসুমে হোটেল-মোটেলগুলো প্রায় পূর্ণ হয়ে গেছে, সৈকতজুড়ে উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছেন পর্যটকরা। কক্সবাজার এখন পর্যটকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) সকাল ও বিকালে সৈকতের সুগন্ধ্যা, লাবণী ও কলাতলি পয়েন্টসহ পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় বিভিন্ন স্থানে সরজমিনে পর্যটকদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে।
টানা ছুটিত কক্সবাজারে আসতে পেরে খুশি পর্যটকরাও। সৈকতের সুগন্ধ্যা পয়েন্ট কথা হয় সিলেট থেকে আসা পর্যটক দম্পতী আনোয়রুল করিম ও লুবনা আক্তারের সঙ্গে, তারা দুইজনে সরকারি চাকরিজীবী।
এই দম্পতী জানান, বৃহস্পতিবার সকালে কক্সবাজারে এসেছেন, উঠছেন হোটেল সী-গালএ। এ দম্পতীর মতে, সৈকত ঘিরে কক্সবাজারে উৎসব আমেজ এর কোন ঘাটতি নেই। চারদিনের ছুটিতে তিনদিন তারা কক্সবাজার ঘুরে দেখবেন। তারা বলেন, নিরাপত্তা যদি ঠিক থাকে তবে অন্য কোন অসুবিধা কক্সবাজারে নেই।
মিরপুর ৩ থেকে সপরিবারের কক্সবাজার ভ্রমণে এসেছেন ছৈয়দ আবুল হোসেন। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারে ১৩ সদস্য নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে আমি কক্সবাজারে এসেছি। সকালে সৈকতে গোসল করতে নেমে সৈকতে লাখো পর্যটক দেখে মনটা ভালো হয়ে গেছে। এ সময় ওসে কক্সবাজারে এভাবে উৎসবমুখর পরিবেশ দেখবো ভাবতে পারিনি। শনিবার পর্যন্ত কক্সবাজারে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ওইদিন রাতে ঢাকায় ফিরে যাবেন বলে জানান পর্যটক ছৈয়দ আবুল হোসেন। একই কথা বলেছেন কক্সবাজার সৈকতে আসা আরও অনেক পর্যটকই।
প্রায় শতভাগ বুকিং হোটেল
কক্সবাজারের পর্যটন ব্যবসায়ীরা দীর্ঘ মন্দার পর এই শারদীয় ছুটিকে ঘিরে বেশ আশাবাদী। পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, আগামী ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত পর্যটক সমাগম সমানভাবে থাকবে কক্সবাজারে। ইতোমধ্যে ১০-১৩ অক্টোবর পর্যন্ত ৯০-৯৮ শতাংশ হোটেল রুম বুকিং হয়েছে। আর ১৪-১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ৮০-৮৫ শতাংশ রুম বুকিং হয়েছে। পর্যটক টানতে প্রায় প্রতিটি হোটেল ৪০-৪৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট দিয়েছে।
ওশান প্যারাডাইস লিমিটেডের বিপণন প্রধান ইমতিয়াজ নূর সুমেল জানান, দীর্ঘদিনের পর্যটন মন্দা কাটিয়ে অবশেষে প্রাণ ফিরেছে। হঠাৎ পাওয়া চার দিনের ছুটির সুযোগ কাজে লাগিয়ে পর্যটকরা আগাম বুকিং করেছেন। ইতোমধ্যে আমাদের হোটেলের ৯৫ শতাংশ রুম বুকড হয়েছে এবং ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত বুকিং রয়েছে ৮০-৮৫ শতাংশ পর্যন্ত।
ইলিশ উৎসব ও বিশেষ ছাড়
পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে হোটেল-মোটেলগুলোতে দেওয়া হচ্ছে বিশেষ ছাড়। প্রায় প্রতিটি হোটেল ৪০-৪৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে। খাবারের মেনুতেও যোগ হয়েছে নতুন আকর্ষণ। ২০ অক্টোবর পর্যন্ত চলছে ইলিশ উৎসব, যেখানে ৮ ধরনের ইলিশ রান্নার স্বাদ নেওয়ার সুযোগ থাকছে। ওশান প্যারাডাইস হোটেলের পরিচালক আবদুল কাদের মিশু জানান, ভিন্ন স্বাদে ভোজনের ব্যবস্থা করে পর্যটকদের আরও আকৃষ্ট করতে আমরা এই আয়োজন করছি। একইভাবে তারকা মানের প্রায় সব হোটেলে ইলিশ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।
কয়কে’শ কোটি টাকা বাণিজ্যের আশা
সেন্ডি বিচ হোটেল ও রেস্তোরাঁর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও বৃহত্তর বিচ ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি আবদুর রহমান বলেন, অনেকদিন পর টানা ছুটিতে পর্যটকে মুখরিত হচ্ছে কক্সবাজার। সৈকতের পুরনো রূপে ফেরার একটি বড় সুযোগ এটি। তবে দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকতে হলে পর্যটন খাতকে আরও আধুনিক ও টেকসই করা দরকার।
পর্যটন খাতে এই ভিড় শুধু অস্থায়ী লাভ নয়, বরং ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন আশার আলোও। কক্সবাজার হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার বলেন, এবারের শারদীয় ছুটি আমাদের জন্য বড় ব্যবসার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। সাত দিনব্যাপী লাখো পর্যটকের আগমনে পুরো পর্যটন খাত চাঙ্গা হবে এবং কয়েক’শ কোটি টাকার বাণিজ্য হবে বলে আশা করছি।
ট্যুর অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (টুয়াক) সভাপতি মো. রেজাউল করিম বলেন, কক্সবাজারে হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস রয়েছে প্রায় পাঁচশত। এসব আবাসনে দৈনিক প্রায় সোয়া লাখ পর্যটকের রাত যাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। তারকা হোটেলগুলো ইতোমধ্যে ৯০ শতাংশ বুকিং হয়েছে। গেস্ট হাউসগুলোও কমবেশি বুকিং হয়েছে। দুর্গাপূজার ছুটি দিয়ে এবারের পর্যটন মৌসুমটা চাঙ্গা হয়ে উঠবে বলে আশা করছি।
কক্সবাজারে পর্যটন ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, শারদীয় দুর্গাপূজার ছুটিতে পর্যটকদের যে ঢল নেমেছে তা কক্সবাজারের পর্যটন খাতকে সাময়িকভাবে চাঙ্গা করতে পারলেও দীর্ঘমেয়াদী উন্নতির জন্য আরও অনেক কিছু করতে হবে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী বলেন, কক্সবাজার দিয়ে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব আয় করে, তার তুলনায় পর্যটন অবকাঠামোগত উন্নয়ন অনেক কম। পর্যটকদের চাহিদা মেটাতে পর্যটন স্পটগুলোর উন্নয়ন এবং নতুন সুযোগ তৈরি করা খুবই প্রয়োজন।
তিনি আরও জানান, সরকারি ছুটির পরও কক্সবাজারে কয়েক লাখ পর্যটক অবস্থান করবে এবং কয়েক’শ কোটি টাকার বাণিজ্য হবে বলে আশা করা হচ্ছে। পর্যটন শিল্পকে টেকসই করতে হলে আরও আধুনিকায়ন এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা
পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে। কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের এসপি মাহফুজুল ইসলাম জানান, প্রতিটি পর্যটন স্পট ও সৈকতের প্রবেশ পথে তল্লাশি চৌকি স্থাপন করা হয়েছে। পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য পোশাকধারী এবং সাদা পোশাকের পুলিশ নিয়োজিত রয়েছে। সৈকতে নিয়মিত টহল এবং পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
এছাড়াও পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য যৌথ টহল এবং মোবাইল টিমও কাজ করছে। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, সৈকতে পর্যটকদের নিরাপদ রাখতে এবং কোনো ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা এড়াতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সৈকতের প্রবেশ পথে তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে, পোশাকধারী পুলিশ ছাড়াও সাদা পোশাকে আমাদের সদস্যরা কাজ করছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, ‘ভ্রমণপিপাসুদের বিচরণ নির্বিঘ্ন করতে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের একাধিক টিম টহলে থাকবে। সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করে সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের প্রসারই আমাদের মূল লক্ষ্য।’