
রাজধানীর ধানমন্ডিতে ‘অলংকার নিকেতন’ জুয়েলার্সের মালিক এম এ হান্নান আজাদের বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ২৬ মার্চ ভোরে ২০-২৫ জনের একটি ডাকাত দল র্যাব, ম্যাজিস্ট্রেট ও ছাত্র পরিচয়ে অভিযানের কথা বলে ওই বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। তারা ভবন মালিক এম এ হান্নান আজাদের বাসা এবং ওই ভবনে অবস্থিত একটি অফিস থেকে স্বর্ণালংকারসহ বিপুল পরিমাণ টাকা লুটে নেয়।
ডাকাত দলের অধিকাংশের গায়ে ছিল র্যাব লেখা কটি। প্রায় ২০ মিনিট ধরে লুটপাট চালিয়ে তারা প্রায় ৩৭ লাখ টাকা ও প্রায় আড়াই ভরি স্বর্ণালংকার নিয়ে পালিয়ে যায়। তবে স্থানীয় লোকজন ও পুলিশের সহযোগিতায় ধরা পরে চারজন।
পুলিশ বলছে, ডাকাতির ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে কিছু টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতার চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ডাকাতির আদ্যোপান্ত জানার চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে পুলিশ।

ভবন মালিক এম এ হান্নান আজাদ বলেন, ‘মুহূর্তের মধ্যে ভবনের ৬-৭টি প্রটেকশন ভেঙে ডাকাতরা যেভাবে উপরে এসেছে, সেই দৃশ্য এখনো চোখের সামনে ভাসছে। নিজের চোখে এমন ভয়ংকর অবস্থা দেখে আমি হতভম্ব।’
যে চারজন গ্রেফতার
ডাকাতির ঘটনায় যে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা হলেন- গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরের ফরহাদ বীন মোশারফ (৩৩), লক্ষ্মীপুরের ইয়াছিন হাসান (২২), নরসিংদীর মোবাশ্বের আহাম্মেদ (২৩) ও নারায়ণগঞ্জ আড়াইহাজারের ওয়াকিল মাহমুদ (২৬)। তাদের কাছ থেকে স্ক্রু ড্রাইভার, স্লাই রেঞ্জ, দুটি কালো রঙের র্যাবের কটি সদৃশ জ্যাকেট, নগদ ৪৫ হাজার টাকা ও দুটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।
পলাতক যারা
ডাকাতির ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে কয়েকজনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন- মো. ইব্রাহিম (৩২), আব্দুল্লাহ, ম্যাজিস্ট্রেট ও র্যাবের ডিআইজি পরিচয় দেওয়া জুসান আমিম, জুসানের কথিত বড় ভাই সফিকুল, জুসানের সহযোগী বাবু, ওমায়েদ, গোয়েন্দা কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়া আতিক ও আহসান। বাকিদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি, তারাও পলাতক।
‘আমরা র্যাবের লোক, গেট খোলেন’
ছয়তলা বাড়িটির পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলা ডুপ্লেক্স করে থাকেন মালিক এম এ হান্নান আজাদ। তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় ‘এস এম সোর্সিং’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অফিস। দ্বিতীয় তলাও ভাড়া দেওয়া।
ওই ভবনে ডাকাতির ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় বাদী হয়ে মামলা করেছেন ভুক্তভোগী এম এ হান্নান আজাদের ভাগনে তৌহিদুল ইসলাম লিমন।
তৌহিদুল ইসলাম লিমন জাগো নিউজকে বলেন, ‘অলংকার নিকেতন জুয়েলার্সের মালিক আমার মামা এম এ হান্নান আজাদ। তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আমি ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। ধানমন্ডির ৮ নম্বর রোডের ছয়তলা বাড়িটিতে ২৬ মার্চ ভোর ৪টা ৪০ মিনিটের দিকে তিনটি মাইক্রোবাস এবং একটি প্রাইভেটকারযোগে ডাকাতরা দলবদ্ধভাবে বাসার সামনে আসে। তারা এসে সিকিউরিটি গার্ডদের বলে, আমরা র্যাবের লোক, আমাদের সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছে, এই বাড়িতে অভিযান চালানো হবে, তাড়াতাড়ি গেট খোলেন। এ সময় ডাকাতদের কয়েকজনের গায়ে র্যাবের কটি পরা ছিল।’
তিনি বলেন, ‘তখন সিকিউরিটি গার্ড তাদের সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু ডাকাতরা সিকিউরিটি গার্ডদের গালাগালি করতে থাকে এবং গেট না খুললে তাদের হত্যার হুমকি দেয়। তাদের মধ্যে একজন উপর দিয়ে উঠে জোর করে গেট খুলে ফেলে। এরপর ডাকাতরা একযোগে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে সিকিউরিটি গার্ড, কেয়ারটেকার শেখ রিয়াজুল ইসলাম, গাড়িচালক বিজয় মিয়াকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। এরপর ডাকাত দল চতুর্থ তলায় এস এম সোর্সিংয়ের গেট ভেঙে পিয়ন দেলোয়ারকে মারধর করে মালিক কত তলায় থাকেন তা জানতে চায়। ডাকাতরা হত্যার ভয় দেখিয়ে দেলোয়ারের কাছে থাকা ৪৫ হাজার ১০০ টাকা ছিনিয়ে নেয়।’

শ্রমিকদের বেতনের জন্য রাখা ৩৫ লাখ টাকা লুট
এরপর তৃতীয় তলায় গিয়ে ডাকাতরা এস এম সোর্সিং অফিসের পিয়নদের মারধর করে চাবি ছিনিয়ে নেয়। অফিসের ড্রয়ার ভেঙে ২২ লাখ টাকা লুট করে নেয়। ডাকাতদের আরেকটি দল একই অফিসের চতুর্থ তলায় গিয়ে আলমারি ভেঙে আরও ১৩ লাখ টাকা লুট করে নেয়। সর্বশেষ অলংকার নিকেতন জুয়েলার্সের মালিক এম এ হান্নান আজাদের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। সেখানে আলমারি ভেঙে নগদ দেড় লাখ টাকা, সোনার দুল ও চেইনসহ প্রায় আড়াই ভরি অলংকার লুট করে নেয়।
‘ঝাঁপিয়ে পড়ে ৪ ডাকাতকে ধরে ফেলি’
গাড়িচালক বিজয় বলেন, ‘সেহরি খেয়ে কেবল শুয়েছি। তখন মালিকের মেয়ে ফোন দিয়ে বলেন বাসায় ডাকাত পড়েছে, দ্রুত আসেন। আমি তাড়াতাড়ি করে এসে দেখি র্যাবের পোশাক পরা সব লোকজন। তারা জোর করে বাসায় ঢুকে সিকিউরিটি গার্ডদের মারধর করে, এরপর কেচি গেট ভেঙে উপরে ওঠে। প্রায় ৪০ মিনিট ধরে এই ঘটনা চলার পর পুলিশ ও স্থানীয়রা ছুটে আসে। তখন আমরা ডাকতদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। এ সময় চার ডাকাতকে ধরে ফেললেও বাকিরা পালিয়ে যায়।’
‘মুহূর্তেই ৬-৭টি প্রটেকশন ভেঙে বাসায় ঢোকে ডাকাতরা’
অলংকার নিকেতন জুয়েলার্সের মালিক এম এ হান্নান আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সেহরি খাওয়া শেষ করে নামাজের জন্য অজু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় ভাঙচুরের বিকট আওয়াজ। আমার রুমের মধ্যে সিসি ক্যামেরার মনিটর ছিল, মনিটরে দেখলাম নিচে ২০-২৫ জন মানুষ। তাদের বেশিরভাগ র্যাবের কটি পরা। মুহূর্তের মধ্যে ৬-৭টি প্রটেকশন ভেঙে সিঁড়ি বেয়ে তাদের উপরে আসতে দেখলাম।’
তিনি বলেন, ‘র্যাবের জ্যাকেট পরা ডাকাতরা আমার রুমে এসে বলে, টাকা-সোনা যা আছে সব দিয়ে দেন। আমি তাদের বললাম, টাকা-সোনা-দানা বাসায় রাখি না। এরপর তারা বলে, না দিলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। তখন বাসার সব রুমের আলমারি, ড্রয়ার তছনছ করে। এরপর আমাকে বাসার নিচে নিয়ে যায় তারা।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এস এম সোর্সিংয়ের একজন কর্মচারী বলেন, ‘বাড়িওয়ালা কততলায় থাকে তা জিজ্ঞাসা করে। প্রথমে না বলায় অনেক মারধর করে মোবাইল কেড়ে নেয়। এরপর পঞ্চম তলায় বাড়িওয়ালার গেট ভেঙে প্রবেশ করে। ২০ মিনিটের মধ্যে তারা সব লুটপাট করে।’
৯৯৯-এর কলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ যায় ঘটনাস্থলে
জানতে চাইলে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ক্যশৈনু জাগো নিউজকে বলেন, বাড়ির মালিকের সন্দেহ হলে তিনি জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল দেন। ফোন পেয়ে পুলিশ গিয়ে ওই বাসা ঘিরে ফেলে এবং স্থানীয়দের সহায়তায় চারজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

অন্যরা পালিয়ে যায় জানিয়ে ওসি বলেন, ডাকাত দলের সদস্যদের ধরতে গিয়ে পুলিশের তিনজন আহত হয়েছেন। গ্রেফতার চারজনকে আদালতে পাঠিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে সাতদিনের রিমান্ড চাওয়া হবে।
র্যাব-ম্যাজিস্ট্রেট-ছাত্র পরিচয় দেয় ডাকতরা
ধানমন্ডি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) শাহ মোস্তফা তারিকুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডাকাতিতে র্যাবের পোশাক ব্যবহার করা হয়েছে। একই সঙ্গে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং ছাত্র পরিচয় দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ চারজনকে গ্রেফতার করেছে।’
তিনি বলেন, ‘ঘটনার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এরই মধ্যে পলাতক কয়েকজন ডাকাতকে শনাক্ত করা হয়েছে। বাকিদের শনাক্তের কাজ চলমান, এরপর তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলবে।’